‘গর্জন’ থেকে গাজন। গাজন উৎসবের মধ্যে মহাদেব-শিব অথবা ধর্মনিরঞ্জনকে বারংবার আহ্বান করার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি গর্জনের মতোই শোনায়। আধুনিক গবেষকরা অবশ্য ‘গা’ অর্থে গ্রাম এবং জনগণকে বোঝাতে ‘জন’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে বলে মনে করেন। তবে প্রথম ব্যাখ্যাটিই আমার গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।
বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির জনপ্রিয় নিদর্শন গাজন উৎসব। মূলত প্রান্তিক সমাজের মানুষ গাজন ও চড়কের ধারক বাহক। এই প্রাচীন উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম- শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন…। আসলে এটি সূর্য ও তার পত্নী বলে কল্পিত পৃথিবীর মিলনের অনুষ্ঠান। চৈত্র মাস থেকে বর্ষার শুরু পর্যন্ত সূর্য যখন দারুণ অগ্নিবাণে প্রখর তখন তার তেজ প্রশমন ও সুবর্ষণ পাবার আশায় কৃষিজীবি সমাজ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
গ্রামের শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে গাজন হয়, সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যার দল সক্রিয় অংশ নেয়, সারা চৈত্র মাস তারা নানারকম কৃচ্ছ্রসাধন করে দেবতার মনস্তুষ্টির চেষ্টা করে। চড়ক গাজন অনুষ্ঠানের একটি অঙ্গ। আপাতদৃষ্টিতে শিবের পুজো হলেও তথাকথিত অন্ত্যজ লোকের অবাধ অংশগ্রহণ করা এই পুজোর প্রাচীনত্ব সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। সম্ভবত গাজন বা চড়ক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত না হবার কারণে পুরাণ ও অন্যান্য হিন্দু শাস্ত্রীয় গ্রন্থে এ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
যাই হোক, এখানে প্রধান দেবতা হলেন কালার্করুদ্র, তিনি তেজোদৃপ্ত, কোটিমার্তন্ডের মত দেহের দীপ্তি, চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি তাঁর তিন নেত্র, মুখে অট্টহাসি। ইনি প্রণতদের ভয় হরণ করেন। এই প্রসঙ্গে অর্চিত দেবীর নাম নীলচন্ডিকা বা নীলপরমেশ্বরী, নীলা বা নীলাবতী। নীল এবং গম্ভীর নামে পুরুষ দেবতারও পুজোর ব্যবস্থা করা হয়।
‘চড়া’ থেকে ‘চড়ক’। কিন্তু কোথায় চড়া?
চড়ক উপলক্ষ্যে ২০-২৫ ফুট উচ্চতার শাল গাছের খুঁটি মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়, তাকে চড়কগাছ বলে। আর একটা দীর্ঘ কাঠের দন্ড এমনভাবে এর মাথায় স্থাপন করা হয় যাতে এটিকে কেন্দ্র করে কাঠের দন্ডটি শূন্যে বৃত্তাকারে আবর্তিত হতে পারে। তার একপ্রান্তে গাজুনে সন্ন্যাসীকে গামছা দিয়ে বেঁধে আর একপ্রান্তে একটি দড়ির সাহায্যে শূন্যে চক্রাকারে ঘোরানো হয়ে থাকে। একটি বড় বাঁকানো লোহার কাঁটা তার পিঠের চামড়ার মধ্যে বঁড়শির মত গেঁথে দেওয়া! কি ভয়ংকর, তাই না?
নেটিভদের এসব নৃশংস নির্মম কান্ডকারখানা দেখে বৃটিশদের তো চক্ষু চড়কগাছ! গ্রামীণ সংস্কৃতির ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল খোদ কলকাতা শহরেও। উনিশ শতকের কলকাতায় চড়ক গাজন বেশ জনপ্রিয় ছিল। বৃটিশ আমলে ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে এই ধর্মাচরণের ভয়াবহ দিকটি স্যার সিসিল বিডনকে চিন্তিত করে তুলল। তাঁরই উদ্যোগে আইন জারি করে এই রীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু শৈবানুরাগী বাঙালি আর স্বদেশপ্রেমী তরুণ সমাজ হিন্দু ধর্মে ব্রিটিশের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করেন। আইনটি সঙ্গত কারণেই বাতিল হয়নি।
ইতিহাসের কী নিদারুণ রসিকতা!
যে বিডন্ সাহেব রক্তাক্ত চড়ক খেলার প্রথম প্রতিবাদ করে তা বন্ধ করেন, তাঁরই নামাঙ্কিত উত্তর কলকাতার বিডন্ স্ট্রিটে ছাতুবাবুর বাজারের ধারে পোস্ট অফিস সংলগ্ন এলাকায় আজও সাড়ম্বরে চড়ক পুজো হয়, মেলা বসে।
“গাজনের বাজনা বাজা, কে মালিক কে সে রাজা…”
প্রান্তজনকে জাগাবার মন্ত্র। সাম্যবাদের প্রচ্ছন্ন বার্তাবাহি।।