চিত্রকলায় শিল্পী সবসময়েই সমকালীন হতে চায়। সেটাই তার সময়কে আপন করে নেওয়ার পথ। বলা যায়, শিল্পের পথে আপন আত্মজগৎকে সে নানাভাবে প্রসারিত করে। প্রসঙ্গত, আধুনিক চিত্রকলার যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যক্তির অন্তর্গত মনোজগৎকে কেন্দ্র করেই। উনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি সামন্তচিন্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যে আধুনিক চিত্রকলা জন্ম নিয়েছিল, বিংশ শতাব্দীতে সেই চিত্রকলা আরও প্রসারিত হয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে। নগরের দ্রুত বিকাশ এবং দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে নাগরিক মনোজগতে যে আশা-হতাশা, দুঃখ-বেদনা, ক্ষমতা-অক্ষমতা, ক্ষয়-অবক্ষয়, একাকিত্ব-বিচ্ছিন্নতা, যুক্তির ঘাত-অভিঘাত, ক্লেদ-যন্ত্রণা, মনোবিকলন ইত্যাদি প্রভৃতির নানা উপাদান চিন্তা চেতনার ভরকেন্দ্রে আবির্ভূত হয়, সেই আধুনিক ভর বিন্দুর উপরেই গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে উত্তর আধুনিক চিত্রকলার উন্মেষ। পরম্পরার দিক থেকে বিবেচনা করলে সাম্প্রতিক কালের চিত্রকরেরা তার অভিযাত্রী।
আধুনিক চিত্রকলার যেমন নানা ধারা তেমনি তার বিভাগও অসংখ্য। তবে আধুনিকতার মূল ভিত বাস্তববাদী চিত্রকলা হলেও, তার অন্য এক অনন্যধারা বিমূর্ততা। চিত্রকলার বিমূর্তবাদী রূপ আসলে প্রচলিত তত্ত্বের ধারণা, শিল্পের প্রাচীন প্রবণতার সর্বশেষ প্রকাশ। যে চিন্তার জন্ম মূলত অবস্তু বা বস্তুর রহস্য বা অধরাকে ধরার অভিপ্রায় থেকেই। কিন্তু আধুনিক চিত্রকলার আরেকটি ধরণ ছিল বাস্তবতার সঙ্গে অধরা বা বিমূর্ত জগতের সম্বন্ধ স্থাপন। সেটি কিন্তু বাস্তবতাবিবর্জিত শিল্পের বাসনা নয়; বরং শিল্পকে বাস্তব অনুষঙ্গের সঙ্গে রহস্যময় নতুন এক শিলকাঠামোতে পৌঁছানোর এক পন্থা। সহজ ভাষায় যা বস্তুর রহস্যঘেরা মানসিক অভিব্যক্তির এক নিরবচ্ছিন্ন রূপ। এই রূপও সহজ বাস্তব নয়। বিমূর্ত ভাবের অর্থকে যদি বলি ভাষা তবে সেটা মুখের, লেখার, চিত্রকলার, ছবির কিংবা যেকোনো ভাষার রূপান্তর মাত্র। বিমূর্ত চিত্রকলায় বস্তুর সহজ বাস্তব রূপ যেমন ধরা হয়, তেমনি বস্তুর বাস্তব রূপকেও অপরিচিত বা রহস্যাবৃত করা হয়।
কিন্তু ‘মিনিয়েচার পোস্ট টিকিট আর্ট শো’-এর সঙ্গে এই গৌরচন্দ্রিকার কী সম্পর্ক! না, কার্যত কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে শিল্পে বস্তু বা বিষয়ের সরল উপস্থাপনাই আনন্দদায়ক। আর সেটা স্থির জীবনের মতো বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। যদিও বিমূর্ত শিল্পে অবয়বের সরল কাঠামো ভেঙে যায়। বস্তুর স্থির জীবন রহস্যময় হয়ে ওঠে। নিরীক্ষার কারণে অবয়ব প্রতীকীভাবে অপরিচিত হয়ে ওঠে। নিরীক্ষামূলক এমন চিত্রকলা দর্শকের সঙ্গে কথা বলে। সেই নিরীক্ষার শর্তই হল শিল্পীর স্বাধীন সত্তার প্রকাশ। এটা সৃজন আর মানসিক সত্তাকে নিরবচ্ছিন্ন রূপের কাছে নিয়ে যায়। তাছাড়া বিমূর্ত চিত্রকলার অভিব্যক্তি হল- যেখানে শিল্পী নয়, শিল্পই কথা বলে। আমরা একটি আবছা অবয়ব বা অবয়বহীনতার ভেতর দিয়ে এক ধরনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাই। কখনো এমনও মনে হয় যে এটি কেবল অনুভূতি নয় অভিঙ্গতা অর্জনের এক নতুন দিগন্ত।
‘চারুবাসনা’, যোগেন চৌধুরী সেন্টার ফর আর্টস-এ ‘মিনিয়েচার পোস্ট টিকিট আর্ট শো’-এর “আর্ট টিকিট”গুলি নিঃসন্দেহে ছবি দেখার অদ্ভুত এক অভিঙ্গতা, যেখানে একটি ছবি সাধারণ ছবির ফ্রেমের তুলনায় খুবই ছোট, ক্যানভাসের আকারের তুলনায় ক্ষুদ্র, স্বভাবতই এই “আর্ট টিকিট”গুলিকে দেখতে হয় চোখের অতিরিক্ত নজরে, বিশেষ এক মনোনিবিষ্টতায়, অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে। আর এইসব দেখার মধ্যে দিয়েই অতটুকু আকারের মধ্যকার আকার–অবয়ব-রং-রেখা-বিন্যাস ভিন্ন এক অভিঙ্গতা দেয়। আপাতভাবে এই দেখা যে ছবি দেখা তা মনে হয়না, মনে হয়না ছবিগুলি শিল্প মানসিক সত্তাকে নিরবচ্ছিন্ন রূপের কাছে নিয়ে গিয়েছে, ছবিগুলির আকার, রেখার চলন কিংবা রঙের বিন্যাস গভীর কোনো সঞ্চারণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু অবয়বের সরল কাঠামো ভেঙেছে, যদিও সমস্ত ছবির ক্ষেত্রে সেকথা বলা যাবে না তবু অনেক অবয়বই প্রতীকীভাবে অপরিচিত হয়ে উঠেছে। ছবি দেখার এই নতুন অভিঙ্গতা মনোনিবেশে এক আলাদা অনুভূতিরও সঞ্চারণ ঘটায়।
ফ্রান্স, ইটালি, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, পর্তুগাল, ভারত, বাংলাদেশ-সহ ১৩টি দেশের প্রায় ২৫০জন শিল্পীর “আর্ট টিকিট” নিয়ে নীলেশ কিনকালে ও সর্বানী সরকারের উদ্যোগে এই মিনিয়েচার পোস্ট টিকিট আর্ট শো মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর হয়ে কলকাতায় হাজির হয়েছে। এরপর তারা পুনে হয়ে জার্মান ও জাপানেও উপস্থিত হবেন। কলকাতার শিল্পীদের মধ্যে যোগেন চৌধুরীর কাজ যেমন রয়েছে পাশাপাশি রয়েছে শমিত দের মতো শিল্পীরও কাজ।