আদি থেকে আজ সভ্যতার এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় একের পর এক কীর্তিস্তম্ভ গড়ে তুলেছে মানুষ, সমৃদ্ধ হয়েছে নানা অর্জনে। মানুষের চিরন্তন কীর্তির তালিকায় এমনই একটি অসাধারণ অর্জন গ্রন্থাগার। জ্ঞান সৃষ্টি, সেই জ্ঞানের কাঠামোবদ্ধ সংরক্ষণ এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জ্ঞানের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করেছে গ্রন্থাগার। সভ্যতার আদিকাল থেকে লিপিবদ্ধ জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে আসছে মানুষ। ইতিহাসের একেবারে প্রাথমিক পর্বে গ্রন্থাগারগুলো আধুনিক গ্রন্থাগারের চেয়ে একেবারেই অন্য রকমের ছিল। গ্রন্থাগার ইতিহাসবিদরা এগুলোকে ‘প্রোটো লাইব্রেরি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এগুলো ছিল ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক প্রয়োজনে গড়ে তোলা সংগ্রহশালা যেগুলো কালের আবর্তে এক সময় গ্রন্থাগারে পরিণত হয়। সংস্কৃতির পীঠস্থান আমাদের ভারতবর্ষ। ভারতের সংস্কৃতি প্রায় কয়েক সহস্রাব্দ-প্রাচীন বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও রীতিনীতিগুলির একটি সম্মিলিত রূপ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন নিদর্শন, যা আজও আমাদের সামনে জীবন্ত করে তোলে দেশের প্রাচীন ইতিহাসকে। ঠিক তেমনই সৃষ্টির ৫০০ বছর পার করে আজও ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাসের বোঝা বয়ে চলেছে থাঞ্জভুরের ঐতিহাসিক ‘সরস্বতী মহল লাইব্রেরি’।
থাঞ্জাভুর শহর তামিলনাড়ুর অন্তর্গত একটি প্রাচীন শহর। এই শহরের প্রাচীন স্হাপত্যগুলির মধ্যে অন্যতম ‘সরস্বতী মহল লাইব্রেরি’। ১৫৩৫ সাল থেকে ১৬৭৪ সাল পর্যন্ত এখান থেকেই শাসনকার্য চালাতেন ‘নায়ক’ রাজবংশের রাজারা। শুধু সামরিক দিক থেকেই নয়, নায়ক রাজাদের শাসনকালে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিল থাঞ্জাভুর। প্রাচীন সাহিত্য সংরক্ষণের জন্য তৈরি হয়েছিল বিশেষ এই লাইব্রেরি। যা তামিলনাড়ু তথা ভারতের প্রাচীনতম ‘জীবিত’ গ্রন্থাগার। নায়কদের শাসনকালের বহু আগে ভারতে একাধিক লাইব্রেরি নির্মিত হয়েছিল। তবে কালের আবহে সেসব হারিয়ে গেলেও আজও নিজের স্বত্বা ধরে রেখেছে ‘সরস্বতী মহল লাইব্রেরি’। ‘সরস্বতী মহল লাইব্রেরি’ স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘মহারাজা সেরফোজির লাইব্রেরি’ হিসাবেও। মজার বিষয় হলো ‘সেরফোজি’ নায়ক রাজবংশের কোনো শাসক নন। তিনি ছিলেন মারাঠা। তবে লাইব্রেরির এই নামকরণের পেছনে রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস।
১৬৭৫ সালে তাঞ্জোর বা বর্তমান থাঞ্জাভুর আক্রমণ করেন মারাঠা সম্রাট। সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেননি নায়করা। অবশ্য তাঞ্জোরের ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলেও, থেমে থাকেনি সাহিত্য সংরক্ষণের কাজ। বরং এই লাইব্রেরিকে সাজিয়ে তুলতে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন মারাঠা মহারাজ সেরফোজি দ্বিতীয়। দূরদর্শী শাসক হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন দার্শনিক, মানবতাবাদী এবং সংস্কৃত পণ্ডিত। সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। থাঞ্জাভুর লাইব্রেরিতে যে-সকল প্রাচীন গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল, সে-সব কিছু দিনের মধ্যেই পড়ে ফেলেন সেরফোজি। তারপর বই-খিদে মেটাতে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আমন্ত্রণ জানান সংস্কৃত পণ্ডিতদের। তাঁদের থেকে শুধু অর্থের বিনিময়ে গ্রন্থ সংগ্রহই নয়, বহু প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের অনুলিপিও তৈরি করিয়েছিলেন সেরফোজি। সংস্কৃত ছাড়াও ছিল তামিল, তেলেগু মারাঠি ও ইংরাজি গ্রন্থও। তাছাড়া সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, তিনি তৈরি করিয়েছিলেন ভারতের সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্য-ধর্মী মানচিত্র। যা রীতিমতো অবাক করার মতোই। মজার বিষয় হল, সতেরো শতকের শেষের দিকে এই লাইব্রেরিতেই মুদ্রিত হয়েছিল বিশ্বের প্রাচীনতম অ্যাটলাস এবং প্রাচীনতম তামিল বাইবেল। যা ২০০৫ সালে চুরি যায় এই লাইব্রেরি থেকে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর এই বাইবেলটির সন্ধান পাওয়া যায় লন্ডন মিউজিয়াম থেকে।
যদিও বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, নায়কদের শাসনকালের বহু আগে থেকেই ভারতের বুকে নির্মিত হয়েছিল একাধিক লাইব্রেরি। তবে সে-সব হারিয়ে গেছে কালের আবহেই। অথচ, ৫০০ বছর পেরিয়েও আজ দাঁড়িয়ে রয়েছে নায়ক রাজাদের এই অপার্থিব সৃষ্টি। আজ এই লাইব্রেরিতে পাণ্ডুলিপির সংখ্যা প্রায় ৪৯ হাজার। যার মধ্যে রয়েছে শুধু ৩৯ হাজার সংস্কৃত গ্রন্থ। সাড়ে ৩ হাজার তামিল এবং ৩ হাজার মারাঠা সাহিত্যের দুর্মূল্য গ্রন্থও রয়েছে এই গ্রন্থাগারে। যাদের মধ্যে উল্লেখ্য, শ্রী রামদাস ও দত্তাত্রেয়ের পাণ্ডুলিপির প্রাচীনতম সংস্করণ। রয়েছে ১৮০৭ সালে মুদ্রিত মাদ্রাজ অ্যালমানক, সেরফোজি দ্বিতীয়র প্রচলন করা নোট, সেরফোজির ব্যবহৃত গ্লোব, মানচিত্র, চিঠিপত্র এবং তাঞ্জোর শহরের নকশা পরিকল্পনার একাধিক প্রাচীন নথি। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ শাসনকালে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই লাইব্রেরির দরজা। তবে তা পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে এই গ্রন্থাগার জনসাধারণের জন্য খুলে দেয় ব্রিটিশ শাসকরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই গ্রন্থাগার তো বটেই, সমগ্র মারাঠা প্যালেসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় ভারত সরকার। এই প্রাচীন লাইব্রেরী শুধু তামিলনাড়ুই নয়, গোটা দেশেরই এক গর্বের জায়গা।