(গত সংখ্যার পর)

বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা বৈঠকখানার ঘরটি। কাঠের বড় বড় দুটো চৌকি, চেয়ার এবং একটি বড় টেবিল রয়েছে একপাশে। টেবিলে সাজানো আছে হারমোনিয়াম, মৃদঙ্গ, ডুগি, একতারা আর শ্রীখোল। খঞ্জনি, ঘুঙুর রয়েছে কুলুঙ্গিতে। পিছনের অংশে গোছানো আছে চরকা ও তার সরঞ্জাম। দেওয়ালে ঝুলছে ঠাকুর দেবতার ছবি-সহ অনেকগুলো ক্যালেন্ডার। কুলুঙ্গিও রয়েছে বেশ কয়েকটি। এই বৈঠকখানাটিকে ঠিক ঘর বলা যায়না। ওয়ার্কশপ বলাটাই ভালো। উত্তরদিকের সীমানা পাঁচিলের সঙ্গে দেওয়াল জুড়ে, দুটো বড় বড় জানালা আর প্রমান সাইজের নকশা তোলা কাঠের দরজা। উত্তরমুখী জানালা দিয়ে দেখা যায় মনোরম শুশুনিয়াকে। মোহময় তার রূপ। উত্তরের বনজঙ্গল-সহ দেখা যায় গাছপালা ঘেরা পাহাড়তলীর ছোট ছোট গাঁ। উপরে সিলিং করা আছে কাঠ পাটাতন দিয়ে। শুশুনিয়ার বেলে পাথরের দেওয়াল। ইটের মতোই সাইজ করে সিমেন্ট বালি দিয়ে গাঁথুনি। কোথাও কেমনে পোড়ামাটির ইটও ব্যাবহার করা হয়েছে প্রয়োজনে। পুরো ঘরখানি টালি আর অ্যাসবেসটাসের ছাউনি। মূল ঘরের পিছনে ও দক্ষিণ দিকে আরও দুটি পাকা ঘর আছে। এইগুলো সরকারি আবাস যোজনা প্রকল্পে পাওয়া। দুটো করে ঘর আর প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে। রান্নাঘর, গোয়াল আর টয়লেট আলাদা আলাদা। আগে জলের তীব্র কষ্ট ছিল এলাকায়। তখন থেকেই তাগিদ ছিল সমস্যা মেটানোর। যার দরুন এই কূয়োখানির জন্ম। শুধু তারাই নয় এই গাঁয়ের বহু পরিবার পানীয় জল নিতে আসে এই কূয়ো থেকে। এখন তো দামোদরের জল আসে পাইপের মাধ্যমে। জ্যেঠামশাই তো বলেই দিলেন- ঘরে ঘরে জল ঘরে ঘরে কল! শুধু জলই নয় সরকারের সামাজিক প্রকল্পগুলো থেকে আর্থিক অনুদানও পেয়ে আসছে। লোকপ্রসার শিল্পী হিসেবে সরকারি মান্যতা পেয়েছে এ বাড়ির তিনজন।

তবুও সরকারি অনুদানের উপর সম্পূর্ণ ভরসা না করে পরিবারকে সচল ও স্বচ্ছল রাখতে সবাই পরিশ্রম করে। শাক সব্জির বাগান থেকে গো-পালন, বেলমালা, কুড়চিমালা ও তুলসীমালা কাটার কাজ করে। একমাত্র পিসিমা টেকুয়া বা টেকোতে কিম্বা চরকা দিয়ে সুতো কাটতে জানে। সেই সুতোয় পৈতেও বানাতে পারে। দোকানে কিম্বা মাধুকরী করতে গিয়ে কিছু চেনা জানা মানুষকে বিক্রিও করা হয়। নিজেদের মাঠে এখনো অল্প পরিমাণে কার্পাস চাষ হয়। গাঁয়ের আরও বেশ কয়েকজন চাষী তুলো চাষ করে। বিশ’পঁচিশ ঘর তাঁতি এখনো নিজেদের জাতবৃত্তি ধরে রেখেছে কোন রকমে। গামছা, ছৈতা (ছয়হাতি ধুতি, খেটো ধুতি, বিছানার চাদর এবং মা বোনেদের জন্য শাড়িও তৈরি করে এখানকার তাঁতি পরিবারগুলো। মহাজন ধরে রাখার চল এখন উঠে গেছে সব তাঁতি পাড়াতেই। বহু আগে এখানে এক দেড়শো তাঁতি পরিবারের বসবাস ছিল। পাওয়ারলুম এসে তাঁতিদের মাকু ও হাতে বোনা তাঁত যন্ত্রের বুকে পা দিয়ে পেটের ভাত কেড়ে নিয়েছে। এখন বাঁকুড়ার সুখ্যাত ও সুনামধারী গামছা-চাদরের বদলে কম দামে মিলছে পাওয়ার লুমের সামগ্ৰী। গয়ার গামছা জলের দরে বিকোচ্ছে দেদার। তাঁত, খাদির জায়গায় সিন্থেটিক, নাইলন, পলিয়েস্টার, ভয়েলের পোশাক পরিচ্ছদ সস্তায় মিলছে সর্বত্র।

মুখসুদ্ধির কৌটা আর খাবার জল রেখে দিয়ে গেল পিসিমা। গৌর শোনালো তার পিসিমার জীবন যন্ত্রনা ও লড়াইয়ের কথা। তার জ্যেঠা ও বাবা দু”ভাই। দু’জনের পর এই পিসিমা। দাদু ঠাকুমা ও বাবা জ্যেঠাদের কাছে বড়ই আদরে মানুষ হয়েছে পিসিমা। ছোট বেলা থেকে গানবাজনার তালিম পেয়েছে পুরোদস্তুর। তেমনই গানের গলা! কীর্তনাঙ্গের গান থেকে বাউল গান রপ্ত করে পারিবারিক পরম্পরায়। প্রতিদিন বাড়িতে সন্ধ্যা আরতির পর গান বাজনার আখড়া বসে বারান্দায়। বাড়ির সদস্যদের পাশাপাশি গাঁয়ের আরও দু’পাঁচ জন তালিম নিতে আসে। সাধু গুরু ও বৈষ্ণবদের সমাহার হত প্রায় দিনই। বহু দূর দূরান্ত থেকেও আসে সাধুসন্তের দল। যোগাযোগ হয়ে যায়, কেন্দুলি, শান্তিনিকেতন, অগ্ৰদ্বীপ, সোনামুখী-সহ নানান মেলা মোচ্ছবে। তাদের বেশ কয়েকটি বড় বড় মেলায় বাঁধা আসর থাকে। আখড়ায় আখড়ায় কেটে যায় বেশ কিছু দিন। আবার নিজেদের ঘরেও শ্রীশ্রী মহাপ্রভুর নামে মোচ্ছব হয় নির্দিষ্ট তিথি ধরে। রাস, দোল, ঝুলন-সহ বড় বড় তিথি ধরে নাম সংকীর্তনের আসর বসে মহাধুমধামে। তার জন্য সারা বছর ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়। কতশত সাধু বাউল ও বৈষ্ণব সাধক আসেন এখানে। তিন ‘চার দিন ধরে চলে বার্ষিক মহোৎসব। শ্রী শ্রী রঘুনাথজীউ তাদের কুলদেবতা। একই সঙ্গে মহাপ্রভুর নামযজ্ঞের আসর বসে। প্রভুর অসীম কৃপায় সবকিছু জোগাড় হয়ে যায়। ভক্ত, পুণ্যার্থী ও গ্ৰামবাসীদের অকৃপণ সহায়তা থাকে মেলা মোচ্ছবকে সার্থক করে তুলতে। গৌরের দাদু গোঁসাই হরিদাস মহন্তের নাম ডাক রয়েছে বহুদূর পর্যন্ত। শিষ্য ভক্তের সংখ্যাও কম নয়। তিনি ছিলেন খড়দাবাসী গোঁসাই কুলের সন্তান।