(গত সংখ্যার পর)
বাঙলার নবজাগরণ ও সমাজ সংস্কারের সেইসব দিনগুলো বর্ণময় আলো ফেলে আনন্দময়ীর জীবনে। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে ফেলেছে প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলির দৃঢ়তায় মোড়া জীবনের ইতিহাস। বই পড়ার আবহ তাদের বাড়ির ট্র্যাডিশন। মা ও মামার বাড়ির সবারই নেশা হল বইপড়া। যার দরুন ছোটবেলা থেকেই তার বইপড়ার ভীষন নেশা। অন্তত সপ্তাহে একবার দু’একজন মেয়ের সঙ্গে লাইব্রেরিতে যেত। গাঁয়ের শেষ মাথায় ছিল এই গ্ৰামীন গ্ৰন্থাগার। গাঁয়েরই রামদাদু ছিল সাইকেল পিওন। সাতসকালেই ঝাঁটপাট দিয়ে খুলে রাখতো এই মানুষের মন্দির। গরমকালের ছুটি পড়লে বা মর্নিং স্কুলের মতো লাইব্রেরিও সকালে খোলা থাকতো। জেলা শহর থেকে আসতেন লাইব্রেরিয়ান। সুন্দর ও সুঠাম দেহের এই প্রভাতবাবুর আচার ব্যবহার যেমন ভালো তেমনি সুন্দর ও ভরাট গলাখানি। যখন কোনও অনুষ্ঠান হয় প্রভাত বাবুর মাইক লাগেনা। গান, কবিতা আবৃত্তিতে তার জুড়ি মেলা ভার এ তল্লাটে। শহরের বড়বড় অনুষ্ঠানে নাকি তার ডাক পড়ে ঘোষক কিম্বা সঞ্চালক হিসেবে। টিভিতে একবার দেখেছিল মূখ্যমন্ত্রীর সফর অনুষ্ঠানে ঘোষকের ভূমিকায়। তখন আনন্দময়ী ক্লাস এইটের ছাত্রী। দু’দিকে বিনুনি করে চুল বাঁধতো। চুলের ডগায় ঝুমকো ফুলের মতো ঝুলতো কমলা ফিতের ফুল। তখন ফ্রক ছেড়ে কমলা পাড় শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ ছিল স্কুলের সব মেয়েদের নির্ধারিত পোশাক। বহু কষ্ট স্বীকার করে বাবা দূর শহর থেকে কিনে এনেছিল ‘লেডি বার্ড ডায়না’ নামের সাইকেল। প্রথম প্রথম উৎসাহিত হয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে গেলেও কিছু দিন পর অন্যান্য বন্ধুদের কষ্ট ও অসহায়তা দেখে আর যায় না সাইকেল চড়ে। পাছে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়, দূরে সরে যায় সেই ভয়েই প্রতিদিন সাইকেলে স্কুল আসা বন্ধ করে দিল।
তাদের গ্ৰামের স্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যা খুবই কম। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া খেটে খাওয়া চাষী পরিবার হোক আর গোয়ালা, কামার ,কুমোর, ধোপা, নাপিত পরিবার থেকে স্কুলে যাওয়ার সংখ্যাটাও নিতান্তই কম। শুধু নৈশ বিদ্যালয় বা সাক্ষরতা কেন্দ্রে ইদানিং উৎসাহ ও হাজিরার সংখ্যাটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়ে চলেছে। তারাও চায় শিখতে পড়তে আর দেশটাকে জানতে। পেটের দায়ে শিশু কিশোর, তরুণ তরুণীদেরও শ্রম দিতে হয় মা বাবার সঙ্গে। তামাম ভারতবাসী জাতবৃত্তি ও বিভাজনের খোলস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি আজও। জাতপাত আর অশিক্ষা কুশিক্ষার বেড়াজাল থেকে বেরোতে পারেনি সমাজ। এর সঙ্গে লেপ্টে আছে ‘কুসংস্কার’ নামের সমাজ সৃষ্ট সামাজিক ব্যাধি।
প্রভাত বাবু শুধু একজন গ্ৰন্থাগারিক নন, সমাজ সংস্কারকও। আমরা এই হুজুগে দেওলিয়াপনা ডিজিট্যাল ওয়েভে খালি চোখে দেখতে পাইনা প্রভাতবাবু ও বামুন পাড়ার শুভ পন্ডিতদের সমাজ সচেতনতার কার্যক্রম। বিন্দু বিন্দু আলো দান করে চলেছেন প্রান্তিক গাঁ গঞ্জগুলিতে। এদের আলোয় আলোকিত আনন্দময়ী, লাবনী, রাজারাম সহ একঝাঁক তরুণ তরুণীঁ তাঁরা স্কুল পড়ুয়া হিসেবে সামাজিক আন্দোলনে দীক্ষিত হতে চায়। সামাজিক ব্যাধিগুলির বেড়া ভাঙতে চায়। সেদিন লাইব্রেরির ফ্রি কোচিং-এ প্রভাতবাবু বলছিলেন সেই সব কথা। শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। অতীতটা জেনে মনটাকে শক্ত করে বেঁধে নেয়। একবার ভারত জুড়ে চলে আসা জাতি ভিত্তিক সংরক্ষণ নিয়ে বেশ উচ্চমানের আলোচনা সভা ও বিতর্ক মূলক অনুষ্ঠান হয় গ্ৰামের লাইব্রেরির মাঠে। এক রকম জোর করেই প্রভাত বাবু গোটা গ্ৰামের মানুষকে শ্রোতা বা দর্শক হিসেবে হাজির করিয়েছিলেন। অংশ নিয়েছিল পাশাপাশি গাঁয়ের ছেলেবুড়ো সবাই। এ ব্যাপারে প্রভাতবাবুই একমাত্র পথিকৃৎ। তাঁর সঙ্গে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেন এলাকার সংস্কৃতিমনা গুটিকয়েক মানুষ। বাইরের জগতটাকে দেখার জন্য প্রভাতবাবু নিয়েছিলেন অনন্য উদ্যোগ।
লাইব্রেরি, পঞ্চায়েত ও উচ্চ বিদ্যালয়ের আর্থিক সহায়তায় পুরী বেড়ানোর ব্যাবস্থা করেন তিনি। সেই প্রথম গাঁয়ের বাছাই করা কিছু পড়ুয়া, অভিভাবক, শিক্ষক ও কমিটির দু’চারজন মাথা রিজার্ভ বাসে চড়ে রওনা হলেন পুরীর উদ্দেশ্যে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিল শিক্ষামূলক ভ্রমণ। যদিও ছোটবেলায় আনন্দময়ী মা বাবার হাত ধরে একবার গিয়েছিলেন দীঘা বেড়াতে। বাড়ির আরও কয়েকজন গিয়েছিল একসঙ্গে। তাদের পাড়া থেকে রিজার্ভ বাস ছেড়েছিল দীঘা ভ্রমনের জন্য। তখন ছিল পড়ন্ত শীতের মরশুম। গোটা পাড়ার মানুষের সে কি কৌতুহল আর উত্তেজনা। ঘোষ পাড়া থেকেও গিয়েছিল কয়েকজন। সেই ভ্রমণের আনন্দ যেন চোখে লেগে আছে আজও । জীবনে প্রথম তারা দেখেছিল উত্তাল সমুদ্রের রূপ। কখনো ভয়ঙ্কর কখনো শান্ত নিরীহ চরিত্রের। ভয়ে ভয়ে আনন্দময়ী নেমেছিল সমুদ্র স্নানে। একটু লুকিয়ে লুকিয়ে মা বাবার চোখে মুখে দেখেছিল প্রশান্তির ছাপ। যেন আনন্দের ঢেও দোলা দিয়েছে তাদের পড়ন্ত বেলার জীবনে। কত হাসি, মজা আর আনন্দ ভরিয়ে দিয়েছিল কানায় কানায়। এখনও ভাবে মা বাবার বন্ডিং নিয়ে। সাবেক দিনের উঠোন জুড়ে ছিল হাসিখুশি আর আনন্দময় জীবন বেদ। মা গাছ লাগালে তার পরিচর্যা করতো বাবা। দু’জনের মধ্যে মাঝে মাঝে খিটিমিটি হত না তা নয়। তবে তার সীমা ছিল বাগান থেকে বড়জোর ঘরের উঠোন পর্যন্ত। ঘরের রাশ থাকতো ঠাকুমা আর ছোট পিসিমনির হাতেই। বাবা তার উপার্জনের প্রায় সবটাই ঢেলে দিত সংসারের পিছনে।
(চলবে)