বাঙালি মহালয়ার দিন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র-র উদাত্ত চন্ডীপাঠ, বাণীকুমারের রচনা আর পঙ্কজ মল্লিকের মতো শিল্পীর গান শোনার জন্য উদগ্রীব থাকেন। ১৯২৭ সালে ১নং গার্স্টিন প্লেসের ভাড়া বাড়িতে যে রেডিও স্টেশন স্থাপন হয় সেখানে বসেই একদিন সকলে মিলে ঠিক করলেন দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সকালে একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? উল্লেখ্য, মুম্বই-এর ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি এই রেডিও স্টেশন স্থাপন করলেবহুপ্রতিভার সমাবেশ ঘটে। ভারতীয় প্রোগ্রামের ডিরেক্টর হিসেবে নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই এলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য বা বাণীকুমার। যোগ দেন রাইচাঁদ বড়াল, হীরেন বসু। ঘোষক ও সংবাদ-পাঠক হিসেবে মোহনবাগানের ১৯১১ সালের ঐতিহাসিক শিল্ডজয়ী দলের হাফব্যাক রাজেন সেনগুন্ত আগেই এসেছিলেন। ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যান পঙ্কজকুমার মল্লিক। বেতার -কেন্দ্র থেকে একটি নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশিত হবে, সম্পাদনার জন্যে আসেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী।

প্রেমাঙ্কুর আতর্থী একদিন বলেন, যা যা অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশাপাশি কিছু অভিনবত্ব আনা দরকার। লেখালেখির জন্য বাণী রয়েছে, রাই সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক্…ভোরবেলায় একটা অনুষ্ঠান লাগিয়ে দাও, লোকজন ভালই নেবে। কথাটা নৃপেন মজুমদারের মনে ধরল। বাণীকুমার ভাবতে বসে গেলেন। একমাস বাদে দুর্গাপুজো। বীরেন ভদ্র বললেন, যদি পুজোকে কেন্দ্র করেই কিছু করা হয় তাতে চণ্ডীপাঠ অবশ্যই থাকবে।সেই শুরু।১৯৩২ সালে মহাষষ্ঠীর সকালে ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’ শিরোনামে এই অনুষ্ঠান প্রথম সম্প্রচারিত হয়। পরের বছর হয় ‘প্রভাতী অনুষ্ঠান’ নামে, ১৯৩৬-এ ‘মহিষাসুর বধ’, ১৯৩৭ সালে শিরোনাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তবে প্রথম দু’বছর অর্থাৎ ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়ে, ১৯৩৪ সাল থেকে মহালয়া-র ভোরে সম্প্রচারিত হতে থাকে। মাঝে কয়েকবার আবার অদলবদল হলেও অবশেষে মহালয়ার ভোরেই সম্প্রচার স্থায়ী হয়।

প্রথম কয়েক বছর অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনায় পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। এছাড়াও ছিলেন পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, সাগির খাঁ প্রমুখ। অধিকাংশ গানে পঙ্কজবাবু সুর করলেও ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’ সুর করেছিলেন পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, ‘শান্তি দিলে ভরি…’ উস্তাদ সাগির খাঁ এবং ‘নিখিল আজি সকল ভোলে …’ গানটিতে রাইচাঁদ বড়াল সুর করেন। প্রসঙ্গত, ‘নিখিল আজি…’ গানটি বহুকাল বাদ গিয়েছে। কেবল ওই গানটি নয় আরও অনেক গান পরে বাদ দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃত-স্তোত্রও অনেক কমানো হয়েছে। প্রথম দিকে এক ঘণ্টার হিসেবে অনুষ্ঠান শুরু হলেও কোনও কোনও বছর দু’ঘণ্টা পর্যন্ত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ চলেছিল। পরে দেড় ঘণ্টায় স্থায়ী হয়। ১৯৭২ সালে স্থায়ী ভাবে রেকর্ড হওয়ার আগে পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানের বহু পরিবর্তন ঘটে। এমনকি ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ বছর দু’টিতে সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে বেতার-কর্তৃপক্ষের মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি অনুপস্থিতছিলেন। ১৯৪৫ সালে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ সামলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য গানের সুর এক রেখেছিলেন।

সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুষ্ঠান হয়১৯৪৫ সালে। সেটির যৌথ সঙ্গীতপরিচালক ছিলেন বিজনবালা ঘোষদস্তিদার ও শচীন দাশ মতিলাল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান একেবারেই জনপ্রিয় হয়নি। ফের ১৯৪৬ সালে‘মহিষাসুরমর্দিনী’ হয় পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনায়।তবে সে বছর কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার কারণে লাইভ সম্পচার হয়না।বেতার কতৃপক্ষ অত রাতে শিল্পীদের নিয়ে আসার ঝুঁকি নেননি৷ ওই একটি বছর বাদ দিলে লাইভ সম্পচার একটানা চলে ১৯৬২ অবধি। এর পর রেকর্ডিং করা অনুষ্ঠান শোনানো হলেও, রেকর্ডারের অনুন্নত মানের জন্য ২-৩ বছর অন্তর নতুন করে রিহার্সাল দিয়ে রেকর্ডিং করা হত, তবে স্থায়ী রেকর্ডিং হয় ১৯৭২ সালে।


‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্থায়ীভাবে রেকর্ড করে রাখার আগে পর্যন্ত বহু খ্যাতনামা শিল্পীরা গান গেয়েছিলেন, আমরা তাঁদের গান শুনিনি, যেমন জগন্ময় মিত্র, রাধারানী দেবী, সাবিত্রী ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, শচীন গুন্ত, বাঁশরী লাহিড়ি, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মজুমদার, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ। এঁদের আগেও কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, প্রফুল্লবালা, বীণাপানি, প্রভাবতী প্রমুখ গেয়েছিলেন। ‘বেতার জগত’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১৯৪০-এ গাইতেন অনিল দাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শৈলদেবী, ইলা ঘোষ, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), কল্পনা হাজরা। তখন ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’গাইতেন শৈল দেবী, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু…’; ১৯৪০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইতেন ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী…’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘তব অচিন্ত্য …’গানটি প্রথম দিকে ছিল না; অন্তর্ভুক্ত হয় পাঁচের দশকে। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে অজস্র শিল্পী বিভিন্ন সময়ে গাইলেও, কৃষ্ণচন্দ্র দে, যূথিকা রায়, শচীন দেব বর্মন, কানন দেবী, কে এল সায়গল, সুধীরলাল চক্রবর্তী, রবীন মজুমদার, মান্না দে’র মতো প্রখ্যাত শিল্পীকোনও দিনই গান করেননি।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যেমন চণ্ডী পাঠ করেন পাশাপাশি সারেঙ্গি বাজাতেন মুন্সী, চেলোআলী, হারমোনিয়াম খুশী মহম্মদ। কেবলমাত্র তা-ই নয়, কবি শামসুর রহমানের লেখা থেকে জানা যায় (কোন বছরের ঘটনা কবি উল্লেখ করেননি), ‘…মহালয়ার দিন প্রত্যুষে আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠানের সূচনা হত স্তোত্রপাঠ দিয়ে। সেই স্তোত্রের অবধারিত পাঠক ছিলেন বীরেন ভদ্র। এক বার মহালয়ার স্তোত্রপাঠের নির্ধারিত সময়ে তিনি বেতারকেন্দ্রে আসতে পারেননি। রেডিওর অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে প্রচার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। নাজির আহমদ জানালেন যদি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন তা হলে তিনি স্তোত্রপাঠ করতে পারেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র নাজির আহমদ তাঁর আবেগময় কণ্ঠস্বরেস্তোত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন।ইতিমধ্যে বীরেন ভদ্র এসে হাজির হয়ে নাজির আহমদের স্তোত্রপাঠ শুনতে থাকেন। কেউ কেউ নাজির আহমদকে থামানোর প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু বীরেন ভদ্র নিষেধ করেন’। নাজির আহমদ আকাশবাণী কলকাতার বিশেষ অনুষ্ঠান ‘কচ ও দেবযানী’তে নীলিমা সেনের সহশিল্পী ছিলেন।
8 Comments
উত্তম কুমার এর কথা লেখা উচিত ছিলো
১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, এরাজ্যে তখন জরুরী অবস্থা চলছে, মহালয়ার ভোরবেলা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে ওঠেনি চিরাচরিত মহিষাসুরমর্দিনী। তার জায়গায় নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। যেখান থেকে বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক সবাই বাদ। পরিবর্তে ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তীর লেখা আলেখ্য, শ্যামল গুপ্ত-র লেখা গান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর আর প্রধান ভাষ্যপাঠক উত্তমকুমার। খোদ রাজধানীর নির্দেশ মেনেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল বেতার কতৃপক্ষ। ওই জরুরী অবস্থার সময়েই ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ থেকে অপসারিত হতে হয়েছিল পঙ্কজকুমার মল্লিককে। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঝড়, জনরোষ, চারপাশের প্রবল চাপে জনসাধারণের চাহিদাকে মর্যাদা দিতে সেই বছরই ষষ্ঠীর দিন ফের সম্প্রচারিত হয় মহিষাসুরমর্দিনী। ১৯৭৭ থেকে স্বমহিমায় মহালয়ার ভোরে ফিরে এসে আজ পর্যন্ত অন্যথা হয়নি।
ওটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। খুবই ছোট ছিলাম তবু একটা কথা মনে হয়েছিল এবার মহালয়া হলো না তাহলে কি দুর্গাপুজো হবে না? পরে আবার মহিষাসুরমর্দিনী হলে নিশ্চিন্ত হলাম । আমাদের কাছে যেটা ছিল আসল মহালয়া ।
অনেক তথ্য জানলাম। তবে নাজির আহমেদের স্তোত্রপাঠের কথা পরে বোধহয় বীরেন ভদ্র স্বীকার করেন নি।
বীরেন ভদ্র পরবর্তীতে অনেক কিছুই স্বীকার করেননি বলে আমিও শুনেছি, কিন্তু তার কোনও তথ্য হাতে নেই।
পরে আকাশবাণী একটি সমীক্ষা করে। সে সময় আমি আকাশবাণীর ইংরেজি বাংলা দুই ভাষার বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুনতাম ও চিঠি লিখতাম। তাই ওঁরা আমাকে(ও) একটি ফর্ম পাঠান। প্রশ্নগুলো মনে নেই। তবে নিজস্ব মতামত দেওয়ার জায়গা ছিল। ধরে নেওয়া যায় সমীক্ষাতেও তীব্র সমালোচনা ধরা পড়েছিল।
তপন, এই লেখার জন্য তোমাকে কুর্ণিশ জানাই। ইতিহাস, নিষ্ঠা ও তথ্যনির্ভরতার সাথে রয়েছে হিন্দু-মুসলিম-খৃস্টান সংস্কৃতির সমন্বয়, যা ধর্ম নিরপেক্ষতার অনুষঙ্গ। শেয়ার করছি।
বহু মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ।