ডিসেম্বর শেষের এক রবিবার। সারাদিন নেই কিছু করবার। দিন কয়েক হলো এক দঙ্গল শিক্ষানবিশ আমলা জড়ো হয়েছি শালবনিতে ৪২ দিনের প্রশিক্ষণে। কি করা যায়? আমি প্রস্তাব দিলাম গনগনি যাওয়ার। এক প্রাক্তন সহকর্মীর কাছ থেকে শুনেছিলাম বাংলার এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কথা। রবিবার বলে অনেকে বাড়ি দিয়েছে পাড়ি একদিনের বিরামে। যে কয়েকজন পড়ে আছি তারাই উদ্যোগ নিয়ে একটা ট্রেকার ভাড়া করলাম। সর্বমোট ১৩ জন। কিন্তু আনলাকি থার্টিন নয়, আমাদের জার্নিটা হলো লাকি থার্টিন। কেন, তা আমরা বুঝতে পারলাম শিলাবতী নদীর ধারে গনগনি ডাঙ্গাতে গিয়ে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গরবেতা থানার অন্তর্গত গনগনি।এখানে শিলাবতী পশ্চিম দিক থেকে এসে ৯০ ডিগ্রী বাঁক নিয়ে উত্তরমুখী হয়েছে।পরে অবশ্য পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল হয়ে দ্বারকেশ্বর নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মিলিত হওয়ার পর নাম রূপনারায়ন। রূপনারায়ন হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানার গাদিয়াড়ায় গিয়ে গঙ্গায় পড়েছে। জনশ্রুতি অনুসারে এখানে ছিল মহাভারতের বকাসুর এর রাজত্ব। এখানেই ভীম বকাসুরকে বধ করেন।
গনগনি ডাঙ্গার লাল প্রান্তর হঠাৎ শেষ হয়ে খাড়া হয়ে নেমে গেছে ৬০/৭০ ফুট নিচে। খুব সুন্দর। শিলাবতী নদী রাঙা কা৺কুড়ে মাটিতে যে ক্ষয় কার্য করেছে তা মনে করাতে পারে চম্বলের বেহড় অথবা কলোরাডোর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন কে। প্রকৃতির কী অপূর্ব সৃষ্টি দেখলাম, তা ভোলার নয়। নদী এখানে যেন তার খা৺ড়া পাড়ে প্রাচীন গুহা মন্দিরের ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছে। গেরুয়া লাল মাটিতে মনোমূগ্ধকর কারুকাজ। নিচে শীর্ণ শিলাবতী, তারপর সাদা বালির চর, তারপর সবুজ উপত্যকা। মন বলে এখানে অনন্তকাল চুপচাপ বসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আপনাকে নিরিবিলি থাকতে দেবেনা পিকনিক পার্টির উৎপাত। গোটা শীতকালে প্রচুর লোক আসে পিকনিক করতে। তাদের সাউন্ডবক্সের চিৎকার, নিজেদের মধ্যে কোলাহল কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তার ওপর পিকনিকের পর গোটা এলাকা তে আবর্জনায় ভরিয়ে দিনের শেষে চলে যাওয়া তো আছেই। ভারতীয়দের মধ্যে কবে যে পরিবেশ সচেতন ভ্রমন মানসিকতা গড়ে উঠবে। আমরা এমনিতে নদীকে এবং নদীর পাড়ে ডাস্টবিন হিসাবে গণ্য করি।
আমরা বিকাল বিকাল গিয়ে পৌঁছে ছিলাম, তাই সূর্য ডোবার পালা তাড়াতাড়ি চলে এল। আমরা নদীর পাড়ের এক দিক দিয়ে নেমেছিলাম শিলাবতী উপত্যকায়, অন্য আরেক দিক দিয়ে উঠলাম ধাপ কাটা মাটির সিড়ি বেয়ে। সূর্যাস্তের কাঁচা সোনারং ছড়িয়ে দিল বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কারুকার্যে। জানিনা কোনদিন কলোরাডোর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে পাবো কিনা, তবে গোধূলি বেলায় কনে দেখা আলোয় বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন কে কোনদিন ভুলবো না। সবাই মোহিত। সবাই আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। আমি মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছি আমার সেই প্রাক্তন সহকর্মীকে। এমন সময় এক পিকনিক পার্টির বক্সে বেজে উঠল বাংলা ব্যান্ড ভূমির গান, “কান্দে শুধু মন কেন কান্দেরে, যখন সোনালী রুপোলি আলো নদীর বুকে বাসা খোঁজেরে”। অস্তমিত সূর্য ও শিলাবতীর জলের সঙ্গে গানটা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। সূর্য ডোবার পর আমরা ট্রেকারে চড়ে বসলাম। সমস্ত পিকনিকের দল হৈচৈ করতে করতে ফিরছে। গনগনির পর কনকনি। অর্থাৎ প্রচন্ড ঠান্ডা পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলের হিম আমাদের হিমশিম খাইয়ে ছাড়ল। ফেরার পথে শালবনি বাস স্ট্যান্ডে সিঙ্গারা খেয়ে একটু উত্তাপ নিলাম।
পথ নির্দেশ: খড়্গপুর আদ্রা লাইনে গরবেতা স্টেশন থেকে চার কিমি। গরবেতা বাসস্ট্যান্ড থেকে আড়াই কিমি। রিক্সা, ভ্যান, টোটো, অটো পর্যাপ্ত।