মধ্যযুগে বিশ্বের সবথেকে বড় বইয়ের ভাণ্ডারটি ছিল বাগদাদে। নাম ছিল বাইতুল হিকমাহ বা হাউস অব উইজডম। বিশ্বের তাবৎ পণ্ডিতকে এখানে আমন্ত্রণ জানানো হত। বাইতুল হিকমাহ ছিল জ্ঞানচর্চার মহামিলনক্ষেত্র।পঞ্চম শতকের কিছু আগে বা পরের সময় থেকে অন্তত নবম শতক পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বইয়ের সংগ্রহ ছিল এই গ্রন্থাগারে। যে কারণে বায়তুল হিকমাহ সবসময়েই মুখরিত থাকত তৎকালীন বড় বড় পন্ডিতদের ভিড়ে। বাগদাদের শাসক আল-মামুন(৮১৩ থেকে ৮৩৩)মূল ভবনকে পরিবর্ধিত করে একটি অ্যাকাডেমি স্থাপন করেন। তারপর থেকে এর নাম হয় বাইতুল হিকমাহ এবং তাঁর সময়ে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এই গ্রন্থাগার।
গ্রন্থাগারের সংগ্রহ আরও বাড়াতে তিনি নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কথিত; সিসিলির রাজকীয় লাইব্রেরির পুরোটাই নিয়ে এসেছিলেন তিনি। তৎকালীন বিশ্বে বিজ্ঞান আর গণিতের উঁচুমানের কিছু পাণ্ডুলিপি ছিল সেখানে। আল-মামুন মূলত সেগুলি কপি করতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে তিনি সিসিলিতে খবর পাঠালে রাজা তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানান, তাঁদের গ্রন্থাগারের প্রায় সব বই তাদের পূর্বপুরুষদের কোনো উপকারে আসেনি। রাজা সেই কারণে খলিফা আল-মামুনকে সম্পূর্ণ লাইব্রেরিই দিয়ে দেন। বলা হয়, ৪০০ উট লেগেছিল সমস্ত বই নিয়ে আসতে। এরপর থেকে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও মানচিত্র অঙ্কনবিদ্যা বেশি চর্চা হত। ভারতীয়, গ্রিক ও পারস্যের অমূল্য গ্রন্থ সংগ্রহের ওপর জোর দেওয়া হয়। সংগ্রহের পর সেগুলি অধ্যয়ন ও আলোচনা চলে দিনের পর দিন। অনুবাদ করার কাজও চলত সমানতালে। প্রায় দেড়শো বছর ধরে বায়তুল হিকমাহতে গ্রিক ও সংস্কৃত ভাষার নানা বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদের কাজ চলে। পিথাগোরাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হিপোক্রিটাস, ইউক্লিড, চরক, আর্যভট্ট বা ব্রহ্মগুপ্তের লেখা অনুবাদ করা হয়। মৌলিক গবেষণার কাজও চলত হিকমায়। বিশেষ করে হিকমাহর গণিতবিদরা খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।
গ্রীক পন্ডিতদের অনেক লেখা আরবিতে তর্জমা করা হয়েছিল। পিথাগোরাস, প্লাটো, অ্যারিস্টোটল, হিপোক্র্যাটস, গ্যালেন, সক্রেটিস, ইউক্লিড কেউ বাদ যাননি। আল-কিন্দি জড়িত ছিলেন অ্যারিস্টোটলের অনুবাদকর্মে, হুনায়ন ইবন ইশহাক করেছিলেন হিপোক্র্যাটসের ভাষান্তর। আরো অনেক প্রসিদ্ধ অনুবাদকের লেখা জমা ছিল বাইতুল হিকমাহতে। সংস্কৃত থেকে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গ্রন্থ ভাষান্তরে বাইতুল হিকমাহর অবদান অনেক। এর ফলেই আরব গণিতবিদেরা শূন্যের ধারণা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পান। সংখ্যা বোঝাতে ভারতে আলাদা চিহ্ন ব্যবহার করা হত। এর উন্নয়ন ঘটিয়ে বর্তমান আরবি সংখ্যাপদ্ধতির প্রচলন হয়। বাইতুল হিকমাহতে বসেই আল জাহিজ নানারকম প্রাণীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে রচনা করেছিলেন বিখ্যাত ‘The Book of Animals’। আল-মালিক নির্ণয় করেছিলেন এমন পরিমাপ যা ব্যবহার করে পৃথিবীর পরিধি নির্ধারণ করেছিলেন ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিদরা। পেশায় চিকিৎসক হুনায়ন ছিলেন খ্রিষ্টান, কিন্তু সেজন্য লাইব্রেরির দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি তার সামনে। বরং মেধাকে আরো বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। জ্ঞানের নানা শাখায় অবদান রেখেছেন হুনায়ন। পৃথিবীর ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা এসব নিয়েও কাজ আছে তার। গ্রীক ওল্ড টেস্টামেন্ট আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন তিনি, দুঃখজনকভাবে সেটা হারিয়ে যায়। তবু নবম শতকের মধ্যভাগে বাইতুল হিকমাহ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইয়ের ভাণ্ডারে পরিণত হয়।
উল্লেখ্য, বাইতুল হিকমাহতের প্রভাব নিয়ে কিছুটা হলেও বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে করেন, যেসব অনুবাদের সঙ্গে বাইতুল হিকমাহতের নাম জড়ানো হয়, তার অনেকগুলির পিছনে বাইতুল হিকমাহতের কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এর প্রভাবে লাইব্রেরি গড়ে তোলার চর্চা শুরু হয় চারদিকে। অনেক ধনবান ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে নির্মাণ করেন স্থানীয় পাঠাগার। অন্যান্য রাষ্ট্রও বাগদাদের আদলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা আরম্ভ করে। ইসলামিক বিশ্বের নামজাদা বিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করতে তৈরি করা হয় বিশাল বিশাল লাইব্রেরি। কিন্তু আল-মামুনের মৃত্যুর পর থেকেই বাইতুল হিকমাহর অবক্ষয় শুরু হয়। পরবর্তী খলিফা আল-মুতাসিমের সময় আব্বাসীয়রা দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে সামারায় প্রশাসনিক অনেক কিছু সরিয়ে নেয়। এরপর থেকে সম্ভবত পরবর্তী খলিফারা লাইব্রেরি টিকিয়ে রাখলেও এর উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেননি।
বাইতুল হিকমাহ চূড়ান্তভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ত্রয়োদশ শতকে। ১২৫৮ সালে ঝড়ের মতো ইরাকে ঢুকে পড়ে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনী, বাগদাদ তছনছ করে দেয় তারা। এককালের জৌলুষময় বাগদাদকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, বাগদাদের অন্য গ্রন্থাগারের সঙ্গে বাইতুল হিকমাহও আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, বাইতুল হিকমাহর অসংখ্য বই টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। বলা হয়, এত বিপুল বইয়ের কালিতে টাইগ্রিস নদীর জল কালো হয়ে যায়। তবে অবরোধের আগেই পারসিয়ান মনীষী নাসিরুদ্দিন আল তুসি প্রায় ৪০ হাজার পাণ্ডুলিপি অন্যত্র সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।