তাঁর উপপাদ্য অনুসারে, সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ, এর লম্ব ও ভূমির বর্গের যোগফলের সমান। সমকোণী ত্রিভুজের তিন বাহুর মধ্যে সম্পর্কের জটিল এই জ্যামিতিক সূত্র কী পিথাগোরাসের আবিষ্কার? এ নিয়ে অবশ্য বিস্তর বিতর্ক আছে। যদিও এটিই বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় জ্যামিতিক সূত্র। কিন্তু এই সূত্র কি পিথাগোরাসই প্রমাণ করেছিলেন? এর পক্ষে যেমন কোনো নিরেট প্রমাণ নেই, তেমনি এটা বাতিল করে দেবার মতো তথ্যও পাওয়া যায় না। কেউ বলেন, পিথাগোরাসের আগেই এই উপপাদ্য ব্যবিলনীয়রা ও চীনা গণিতবিদরা সমাধান করেছিল। তবে এটাও জানা যায় না যে এই জ্যামিতিক সূত্র একবারই আবিষ্কার হয়েছিল নাকি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় আবিষ্কার হয়েছিল। অন্যদিকে ইতিহাসে পিথাগোরাসের অস্তিত্ব নিয়েই কোনো সুষ্ঠু প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ মনে করেন, গ্রিক চিন্তাবিদ পিথাগোরাসকে পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে। যদিও তাঁকে একজন দার্শনিক এবং গণিতবিদ হিসেবে মনে করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রাচীনকালে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবে, যিনি সংখ্যাতত্ত্ব এবং মানবাত্মার স্থানান্তরের বিষয় নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাঁর সূত্র নিয়েও বলা হয় যে, পিথাগোরাস যেহেতু ব্যাবিলনে গিয়েছিলেন, তিনি সেখান থেকে এটি শিখে এসে গ্রিসের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন এবং পরবর্তীকালে গ্রিস থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বইতে তাঁকেই এর কৃতিত্ব দেওয়া হয়। আর এভাবেই বিশ্বজুড়ে এটি পরিচিতি পায় ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্য’ হিসেবে।
কেবল পিথাগোরাসের উপপাদ্য নিয়ে নয়, তাঁর জন্মের সময়কাল নিয়েও খানিকটা দ্বিমত আছে। তবে অধিকাংশের ধারণা ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর জন্ম। কিন্তু তাঁর জন্মস্থানের ব্যাপারে ইতিহাসবিদেরা একমত- প্রাচীন গ্রীসের সামোসক তাঁর জন্মস্থান। মনে করা হয় তাঁর মা ছিলেন এই দ্বীপেরই বাসিন্দা আর বাবা ছিলেন প্রাচীন শহর টায়ারের একজন বণিক। পিথাগোরাসকে নিয়ে যত মিথ আছে তার মধ্যে একটি হল তিনি সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর সন্তান। তাঁর অনেক জীবনীকার লিখেছেন, পিথাগোরাসের জন্মের আগেই তার বাবা-মাকে এক সাধু বলে যান তাদের ছেলে জ্ঞান ও দর্শনে পৃথিবীর অন্য সব মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে। অ্যারিস্টটলের এক শিষ্য পিথাগোরাস মারা যাওয়ার কয়েক শতক পরে লেখেন, “পিথাগোরাস ছিলেন খুবই লম্বা এবং অভিজাত দেখতে।”ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে পিথাগোরাস সম্পর্কে বলা হয় ৫৩২ খ্রিস্টপূর্বে তিনি সামোস থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নেন, সেখানকার স্বৈরশাসন থেকে পালিয়ে ইতালিতে যান এবং জীবনের বাকি অধ্যায় সেখানেই শেষ হয়।
তবে পিথাগোরাস বা তাঁর উপপাদ্য নিয়ে বিতর্কে একথাও বলা হয় যে পিথাগোরাসের উপপাদ্যের জনক পিথাগোরাস নন! তাহলে কে? এর উত্তরে অনেকেই প্রাচীন ভারতে এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল বলে জানিয়েছেন। জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর আগে ভারতীয়দের মধ্যেও বৌধায়ন, আপস্তম্ব, কাত্যায়ন প্রমুখ পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি বিভিন্ন ভাবধারায় প্রকাশ করেছেন । তার মানে পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ধারণা এবং পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেটের ব্যবহার হিন্দু গণিতবিদদের কাছে খ্রিস্টের জন্মের ৮০০ থেকে ৫০০ বছর আগে থেকেই ছিল। বিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্য তাঁর ‘লীলাবতী’ গ্রন্থে পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেটের উল্লেখ করেছেন নানাবিধ প্রশ্নের মাধ্যমে। দিয়েছেন উপপাদ্যটির প্রত্যক্ষ প্রমাণ। যার একটি স্কুলপাঠ্য। অন্যদিকে গ্রিক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ পিথাগোরাসের জন্ম খ্রিস্টের জন্মের ৫৭০ বছর আগে। তাঁর কাছে ‘সংখ্যাই সব’, জীবনের প্রতিটি গতিপ্রকৃতি সংখ্যার ছন্দে বাঁধা। বর্তমান দক্ষিণ পূর্ব ইতালিতে তাঁর দর্শনে প্রভাবিত স্কুল ‘দ্য সেমি সার্কেল অফ পিথাগোরাস’ বা পিথাগোরিয়ান স্কুল নামে পরিচিত ছিল।
পিথাগোরিয়ান স্কুলে আধা ধর্ম আর আধা বিজ্ঞানের চর্চা হত। বেশিরভাগ মতামত মুখে মুখে প্রচারিত ছিল, লিখিত তত্ত্বের প্রসার সেভাবে ছিল না। স্কুলের সদস্যদের গোপনীয়তা ছিল অদ্ভুত, যা পিথাগোরাসকে আরও রহস্যময় করেছে। পিথাগোরিয়ানদের বিশ্বাস ছিল শুধু পূর্ণ সংখ্যায়, আর তাদের সরল অনুপাতে। তারা পূর্ণ সংখ্যায় ঈশ্বরের আশীর্বাদ দেখত। তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হল বর্গক্ষেত্রের কর্ণের দৈর্ঘ্য। এটি আবার একটি অমূলদ সংখ্যা। যা তাদের ঈশ্বর দর্শনের বিরোধী। তাই গোপনীয়তা বজায় রাখতে পরস্পর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল যে অমূলদ সংখ্যার ধারণা তারা বাইরে কাওকে জানাবে না। হিপ্পাসুস নামে একজন পিথাগোরিয়ান শিষ্য এ-কথা বাইরে প্রকাশ করলে তাকে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। পিথাগোরাস নিজেও ‘দ্য সেমি সার্কেল অফ পিথাগোরাস’। এর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সদস্যদের হাতে খুন হয়ে যান। কেউ বলেন তিনি আত্মহত্যা করেন।
পিথাগোরাসের উপপাদ্য পিথাগোরাস নিজে আবিষ্কার করেননি, একথা যেমন তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলা হচ্ছে তেমনি এও বলা যায় যে, তিনি হয়তো পুনরাবিষ্কার করেছেন। কিন্তু এও দেখা যাচ্ছে, পিথাগোরাসের প্রায় ১ হাজার বছর আগে থেকেই উপপাদ্যটি প্রচলিত ছিল । প্রাচীন ব্যাবিলনের একটি মাটির খণ্ড বা ট্যাবলেটে দেখা গিয়েছে, যে উপপাদ্য ব্যবহার করে একটি চতুর্ভুজের ভেতরের কর্ণের দৈর্ঘ্য হিসাব করা হয়েছে। ট্যাবলেটটির নাম দেওয়া হয়েছে আইএম ৬৭১১৮। উল্লেখ্য চতুর্ভুজের বিপরীত দুই কোণের সংযোগ রেখাকেই কর্ণ বলে। কেবল তাই নয়, খ্রিস্টপূর্ব ১৮ থেকে ১৬ শতকের আরেকটি ট্যাবলেট পাওয়া গেছে যেখানে একটি বর্গের মধ্যে একটি চিহ্নিত ত্রিভুজ দেখা যাচ্ছে। ব্যবিলনীয়রা স্পষ্টতই পিথাগোরাসের উপপাদ্য জানত। বলা বাহুল্য, সে কালে এটাকে নিশ্চয়ই পিথাগোরাসের উপপাদ্য বলা হত না।