ইতিহাসে আনারকলি নামে কী সত্যি কোনো চরিত্র ছিল, নাকি সবই কেবল লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া একটি গল্প? ১৯২২ সালে ইমতিয়াজ আলী “আনারকলি” নামে একটি নাটক রচনা করেছিলেন, পরবর্তীতে তিনিই সেই গল্প দিয়ে একটি সিনেমা বানান। সেটি ১৯২৮ সালে মুক্তি পায়, অভিনয় করেছিলেন দু’জন বাঙালি অভিনয়শিল্পী প্রফুল্ল রায় ও চারু রায়। সিনেমাটি সেই সময় আনারকলিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জীবন্ত রূপ দেয়। ঐতিহাসিক চরিত্রটিকে মানুষ ধীরে ধীরে সত্যি বলে মেনে নেয়। এর অনেক পরে ১৯৬০ সালে কে আসিফ নির্মিত “মুঘল-ই-আজম” সিনেমাটি আনারকলি চরিত্রটিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। এই ছবিতে আকবরপুত্র সেলিম (সমাট জাহাঙ্গির) ও মোঘল দরবারের নর্তকী আনারকলির সঙ্গে গভীর প্রণয় দেখানো হয়েছে, যে ভালোবাসার অপরাধে আকবর আনারকলিকে জীবন্ত সমাধিস্থ করেন।“মুঘল-ই-আজম।” দিলীপ কুমার আর মধুবালার অসাধারণ অভিনয়ে মানুষের মনে আনারকলি আর সেলিমের জন্য ভালোবাসা জমতে থাকে। যদিও এই ছবিতে আনারকলিকে জীবন্ত সমাধিস্থ করা দেখানো হয়নি। সেখানে আনারকলি দেওয়ালের লুকানো গুপ্ত দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এই ঘটনার সত্যতা কতটুকু? সত্যিই কি আনারকলিকে মোঘল সম্রাট জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন নাকি আনারকলি বলে ইতিহাসে কোনো চরিত্রই ছিল না?

সত্যতা খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হয় ষোলোশো শতাব্দীর লাহোরে। এই শহরের মাঝখানে একটি বাজার আছে যার নাম আনারকলি বাজার। সেই বাজারের পাশেই রয়েছে এক সমাধিসৌধ। সবাই যেটিকে আনারকলির সমাধি বলেই জানে। সমাধির গায়ের এপিটাফ থেকে জানা যায়, যিনি এখানে শায়িত আছেন তার মৃত্যুর সময়কাল ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ। পরবর্তীতে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে সমাধিসৌধ সংস্কার করা হয়। নান্দনিক সৌন্দর্যে মার্বেল পাথর দিয়ে খচিত এই সমাধির গায়ে ফার্সি ভাষায় লেখা আছে একটি কবিতা- “আমি যদি আমার প্রিয়তমার মুখটি আবার দু’হাতে ছুঁতে পারতাম, তবে কেয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতাম।” এতো সুন্দর কবিতা শুধুমাত্র একজন প্রেমিকই তার প্রিয়তমার জন্য লিখতে পারেন। কবির নামও সমাধির নীচে লেখা আছে, তিনি হলেন আকবরপুত্র সেলিম।

ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, তুর্কমেনের বংশোদ্ভূত আনারকলির আসল নাম ছিল নাদিরা বেগম বা শার্ফ-উন-নিসা। বলা হয়ে থাকে, এক বণিক দলের সঙ্গে ইরান থেকে নাদিরা বানু লাহোর এসেছিলেন এবং সেখান থেকে মোঘল সম্রাটের হারেমে একজন কানিজ হয়ে। তার গায়ের রং আনারের মতো বা ডালিম ফুলের মতো সুন্দর ছিল বলে সম্রাট আকবর তাঁর নাম দিয়েছিলেন আনারকলি। তাঁর অসাধারণ রূপের কারণে আনারকলির প্রেমে পড়েন আকবরপুত্র সেলিম। তাদের এই সম্পর্ক সম্রাট আকবর কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তাই ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অপরাধে আনারকলিকে আকবর জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন। কিন্তু লাহারের আনারকলি বাজারের সেই সমাধি কী আনারকলির?

মোঘল সম্রাটেরা নিজেদের আত্মজীবনী লেখার ব্যাপারে খুবই যত্নশীল ছিলেন। “আকবরনামা”-র লেখক আবুল ফজল আকবরের শাসনামলের বড় ঘটনা থেকে শুরু করে ছোটোখাটো ঘটনারও উল্লেখ করেছেন। এমনকি সম্রাট জাহাঙ্গীর যে হিংসায় বশবর্তী হয়ে আবুল ফজলকে হত্যা করেছিলেন, সে ঘটনাটিও জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী “তুজুক-ই-জাহাঙ্গীর”-এ উল্লেখ আছে। কিন্তু “আকবরনামা”তে নেই, যদিও সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরও তার প্রিয়তমা আনারকলির প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ নিজের আত্মজীবনীতে লিখে যাননি। এমনকি সেই সময়ের কোনো ইতিহাসেও আনারকলি নামের কোনো নারীর নাম উল্লেখ নেই। তাহলে কী যুগে যুগে আনারকলি ও সেলিমের প্রেম কাহিনী আমরা কেবল শুনে আসছি বা দেখে আসছি? তাহলেও সেই কাহিনির ভিত্তি কি?

যেকোনো রাজবংশের ইতিহাসেই প্রেমোপাখ্যান জড়িয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে মোগল রাজবংশও পিছিয়ে নেই। হুমায়ুনের সঙ্গে হামিদা থেকে আরম্ভ করে দারার সঙ্গে রাণাদিলের প্রেম পেরিয়ে বাহাদুর শাহ্ জাফরের সঙ্গে বেগম জিনাত মহলের সম্পর্ক সম্বন্ধেও বহু কথা প্রচলিত। যদিও এসব উপাখ্যানের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না, কিন্তু জনমানসে এদের প্রভাবের কমতি নেই। এদিক থেকে মোগল রাজবংশের ইতিহাস এবং উপাখ্যানে আনারকলিই হয়তো সবচেয়ে বিখ্যাত প্রেমিকা, আলোচিত ও আজ পর্যন্ত জনমানসে জীবন্ত। এমনকি শিল্পী-সাহিত্যিকদের পর্যন্ত তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো আনারকলি সম্বন্ধে ইতিহাস তেমন কোনো প্রামাণ, তথ্য দিতে পারে না। আনারকলিকে নিয়ে যা পাওয়া যায় তার প্রায় সবটাই লোকমুখে প্রচলিত কথা। মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিককালে সেলুলয়েড আর ছাপা সাহিত্যকর্মে আনারকলি আরো বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠেন।