রাজা ব্যানার্জি
প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো রাম মন্দির- বাবরি মসজিদ বিতর্কটি মূলত হিন্দু মুসলিম বিতর্ক। বিতর্কটা আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ওই ঘটনার পর গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দাঙ্গার খবর এলেও, অযোধ্যা নগরী বা ফৈজাবাদ জেলাতে কোন দাঙ্গা হয়নি। এখন অবশ্য ফৈজাবাদ নামে কোন জেলা নেই। যোগী আদিত্যনাথের রাজত্বে এলাহাবাদ, মুঘলসরাই-র মত ফৈজাবাদেরও নাম পাল্টে গোটা জেলাই এখন অযোধ্যা। ছোট্ট অযোধ্যা নগরীতে মুসলিম আছেন প্রায় ৩০ হাজার, গোটা জেলায় ৮ লক্ষ। দীর্ঘদিন ধরেই মিলেমিশে একসাথে সহাবস্থান করছেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। সুখে-দুঃখে, বিবাহে-মৃত্যুতে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে গেলে ধর্ম বাধা হয়নি কখনোই।
রাম জন্মভূমিতে ঢুকতে গেলে প্রথমেই পড়বে হনুমানগঢ়ি। একটি ছোট্ট টিলার মাথায় হনুমানের মন্দির। বিশ্বাস করা হয়, ওই টিলার উপর বসেই রামচন্দ্রের বাসভবন পাহারা দিতেন পবনপুত্র। হনুমানগঢ়ির রাস্তা জুড়ে নানা রকম পসরা সাজিয়ে বসে আছে হাজারো দোকান। যে কোনো তীর্থস্থানের প্রবেশ পথে যেমন দেখা যায়। প্রচুর দোকান রয়েছে যার মালিক মুসলিম। রাম-সীতা-হনুমানের দেওয়ালচিত্র কিংবা পট থেকে শুরু করে ওঁ বা স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা পতাকা – বাড়িতে বসেই বংশ পরম্পরায় এইসব বানান তাঁরা। রাম মন্দির বিতর্কের নিষ্পত্তি হাসি ফুটিয়েছে তাঁদের মুখে। তাঁদেরই একজন ইউসুফ জামাল, ফুলের দোকানী। জানালেন, প্রশাসনের কড়াকড়িতে দর্শনার্থীরা খোলা মনে আসতে পারেন না। আদালতের রায় হোক বা অন্য যেকোনো কারণে যখন-তখন কারফিউ ডেকে দেওয়া হতো, মার খেত ব্যবসা। এবার সেই সমস্যা ঘুচলো।
শীর্ষ আদালতের রায়ে খুশি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের হয়ে এই মামলার অন্যতম অংশীদার ইকবাল আনসারি। বললেন, রাম মন্দির হোক তা তো আমরাও চাই। কয়েক পুরুষ ধরে এখানে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে রয়েছে। তার সঙ্গে এটাও চাই, যে ভাবে মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল তার প্রতিকার করুক আদালত। শাস্তি হোক দোষীদের। আর মনে রাখবেন, ঐদিন কোন স্থানীয় হিন্দু কিন্তু মসজিদে চড়াও হয় নি। যা করেছে সব বাইরে থেকে আসা গুন্ডারা।
ঘিঞ্জি অযোধ্যা নগরীতে হাঁফ ছাড়ার জায়গা হল সরযূর তীর। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ সকলেই প্রাতঃভ্রমণ বা সান্ধ্যভ্রমণ সারতে আসেন নদীর ধারে। এই নদীতেই একদিকে যেমন হয় তর্পণ, আরতি তেমনই রয়েছে নৌকা বিহারের ব্যবস্থাও। নদীর পাড়ে বসে ছেলে ছোকরাদের আড্ডা। তেমনই এক স্থানীয় যুবক পারভেজ আলম। বয়স বছর পঁচিশ। জোর গলায় বললেন, এই রায়টার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন তিনি। অবশেষে মন্দির যে হচ্ছে, এটা তাঁর কাছে অত্যন্ত খুশির খবর। বাকি যুবকদেরও একই মত। সবার সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল তার সারমর্ম হলো, ধর্ম আর রাজনীতির কারবারিরা নিজেদের স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে রেখেছেন রাম মন্দির বিতর্ক। তাতে শুধু ক্ষতি নয়, সর্বনাশ হয়েছে অযোধ্যার। কোনো উন্নয়ন হয়নি শহরে, পড়াশোনা করেও উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছেন না তাঁরা। এঁদেরই কেউ সামান্য চার-পাঁচ হাজার টাকা মাইনে তে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ এর কাজ করেন। কেউ দোকানে দোকানে মাল ফেরি করে বেড়ান, কেউ আবার সম্পূর্ণ বেকার। সরকার জানিয়েছে, রাম মন্দিরকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তৈরি হবে এয়ারপোর্ট, বানানো হবে পাঁচতারা হোটেল। এক ধাক্কায় বেড়ে যাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। সেই আশাতেই বুক বেঁধে আছেন তাঁরা। স্থানীয় এক তরতাজা যুবক পরিষ্কার বললেন, এসব মন্দির মসজিদ নিয়ে আমরা ভাবি না। কোথায় মন্দির ছিল আমরা জানিনা। মসজিদও ধ্বংস হয়েছিল আমাদের জন্মের আগে। আমরা চাই কাজ, রোজগার। অনেক কষ্টে বাবা-মা আমাদের বড় করেছেন। দুটো উপার্জন করে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে চাই আমরা।