কোজাগরী পূর্ণিমায় বাঙালির ঘরে ঘরে বন্দিত হন সম্পদের দেবী লক্ষ্মী। যুগ-যুগান্ত ধরে বাংলায় তাঁর আরাধনা চলছে। এদিন কেউ বাড়িতে লক্ষী প্রতিমার পুজো করেন, কেউ সরা, কেউ আবার কলা বউ পুজো করেন। কিন্তু কোজাগরীর রাতে দুই বোনকে পাশাপাশি বসিয়ে পুজো করাটা দস্তুর ঝাড়গ্রামের বিনপুর এলাকার হাড়দা গ্রামে। এখানে একই সঙ্গে পুজো হয় সম্পদ ও বিদ্যার দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতীর। কেবল দুই বোন নন, ওঁদের দু’জনের সঙ্গে পুজো হয় নারায়ণ-এর। এঁদের পাশে থাকেন চার জন সখী। এই রীতি হাড়দা গ্রামের মণ্ডলদের পারিবারিক হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে হয়ে গিয়েছে গ্রামের সকলের পুজো। পুজোয় অংশ নেন আশেপাশের গ্রামের মানুষও। তবে পুজোর সমস্ত খরচ বহন করেন মণ্ডল পরিবার৷ লক্ষ্মী পুজোকে কেন্দ্র করে পাঁচদিনের মেলা বসে গ্রামে।

একইসঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী ও নারায়ণ পুজো ঘিরে এই গ্রামে গল্প চালু আছে। প্রায় দু’শো বছর আগের মণ্ডলদের অবস্থা আজকের মতো ছিল না। কোনওক্রমে দিন গুজরান হত চাষাবাদ করে। এর ওপর জাতপাতের প্রাচীন ধারণা অনুসারে মন্ডলরা নীচু জাত বলে গণ্য হত। গ্রামের তথাকথিত উঁচু জাতের লোকেদের বাড়িতে মন্ডলরা যাতায়াত করতে পারতো না। মণ্ডলেদের কেউ তথাকথিত উঁচু বাড়িতে গেলে গোবর জল ছেটানো হত। ঝাড়গ্রাম তখন ছিল খরাপ্রবণ এলাকা। চাষাবাদ নিয়ে কৃষকেরা সারা বছর চিন্তায় থাকত। একসময় মন্ডল পরিবারের কর্তা সুরেন্দ্রনাথ মণ্ডল মনে মনে ঠিক করলেন মা লক্ষীর পুজো করবেন। তারপরই মন্ডলদের এক গুরুদেব সুরেন্দ্রনাথ মন্ডলকে পুজো করার অনুমতি দেন। কথিত এক সময় হাড়দা গ্রামের শুঁড়ি সম্প্রদায়ের মানুষরা গ্রামের ‘মোড়ল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয়রা ওই পরিবারগুলিকে ‘মণ্ডল-বাকুল’ বলা হত। কথিত গ্রামের বাসিন্দা অক্রুর মণ্ডল বিদ্যা ও সম্পদের দুই দেবীকে একসঙ্গে পুজো করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তারপর থেকেই এই পুজোর শুরু।

আঞ্চলিক ইতিহাস জানাচ্ছে, চৈতন্যদেব পুরী থেকে নবদ্বীপ ফেরার পথে ঝাড়গ্রাম এলাকায় অন্ত্যজ মানুষদের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণ্ডলরা যে কারণে নারায়ণের সেবা করেন। আর তাই একচালার লক্ষ্মী প্রতিমার ওপর নারায়ণ। যে হাড়দা গ্রামে সে সময় এই ধরণের লক্ষ্মী পুজো শুরু হয়েছিল তখন প্রায় ৬০টি মণ্ডল পরিবার বাস করত। এখন সেই পরিবারের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। তবে হাড়দা গ্রামের সবার পদবি যে মণ্ডল তা নয়। অন্য পদবির মানুষও রয়েছেন এই গ্রামে৷ বহু বছর ধরে লক্ষ্মীপুজো হাড়দা গ্রামে শারদোত্সবের চেহারা নেয়। কেবল প্রতিমাই যে ভিন্ন ধরণের তা নয়, পুজোর প্রসাদেও আছে বিশেষত্ব। লক্ষ্মীকে দেওয়া হয় বিশেষ একপ্রকার লাড্ডু। আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল লক্ষ্মীর নৈবেদ্যে কোনও কাটা ফল দেওয়া হয় না, সব ফল গোটা দেওয়া হয়।

হাড়দা গ্রামের লক্ষ্মী পুজোর অন্যতম আকর্ষণ হল অমৃতি বা জিলিপি। ক্ষিরপায়ের বাবরশা, পাঁশকুড়ার চপ, শক্তিগড়ের ল্যাংচা যেমন বিখ্যাত, ঠিক তেমনই হাড়দা গ্রামের লক্ষী পুজোতে দেখা মেলে নানা আকৃতির অমৃতি বা জিলিপি। লক্ষ্মী পুজো উপলক্ষে হাড়দা গ্রামে পাঁচ দিনের যে মেলা বসে সেখানে প্রচুর লাড্ডু বিক্রি হয়। জানা গিয়েছে পাঁচ দিনের মেলাতে এখানে ১০০ কুইন্টালের ওপর জিলিপি বিক্রি হয়। পুজোর প্রায় এক থেকে দেড় মাস আগেই এই অমৃতির দোকান নিলাম হয়ে যায়। দোকানের দর ওঠে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। বহু দূরের গ্রাম থেকে মেলায় আসেন মানুষ। বিরাট আকৃতির জিলিপিও দেখার মতো।

কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষীর পাশে নারায়ণ রেখে পুজো হয় রায়গঞ্জের টেনহরি গ্রামে। এখানে দুর্গাপুজোয় তেমন মাতামাতি থাকে না। এই গ্রামের সবাই অপেক্ষা করে থাকেন লক্ষ্মীপুজোর জন্য। এমনকি দুর্গা পুজোর পরিবর্তে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোতেই গ্রামবাসীরা নতুন জামাকাপড় পড়েন। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রায়গঞ্জের টেনহরি গ্রামের লক্ষ্মী পুজো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। লক্ষ্মী পুজোই এখানকার মানুষের সব থেকে বড় উৎসব।

গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, হেমন্তের শুরুতে মাঠ জুড়ে যে সোনার ফসল ফলে তা লক্ষ্মী পুজোরই ফল। গ্রামের শ্রীবৃদ্ধিও ঘটে লক্ষী পুজোতে। এই বিশ্বাস নিয়ে গত ষাট বছর ধরে রায়গঞ্জের টেনহরি গ্রামের মানুষ মহাসমারোহে লক্ষ্মী পুজো করে আসছে। দুর্গা পুজো এখানে হয় না বললেই চলে। গ্রামবাসীদের যত ভাবনা লক্ষ্মীপুজো ঘিরে। টেনহরি গ্রামে কোজাগরী লক্ষ্মীর বিশেষত্ব হল লক্ষ্মীর পাশে থাকেন নারায়ণ। আর তাদের ঘিরে থাকে দুই সখী জয়া ও বিজয়া। লক্ষ্মীর সামনে থাকে গরুর পাখি। পুজো উপলক্ষে বিরাট মেলা বসে। কথিত বহু বছর আগে পূর্ব বাংলা থেকে বেশ কিছু মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিল টেনহরি গ্রামে। তখন ওই এলাকায় ভাল ফসল ফলত না। একবার লক্ষ্মীপুজো ধুমধুাম করে হয়। তারপরই শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে এলাকার জমি। সেই থেকে লক্ষ্মীই গ্রামবাসীদের প্রধান আরাধ্যা হয়ে যায়।