দুর্গাপুজোয় আনন্দ তেমন হয়না বললেই চলে। হাওড়ার খালনা আদতে অপেক্ষা করে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর জন্য। চন্দননগরে যেমন জগদ্ধাত্রী আরাধনার জন্য বিখ্যাত, খালনার তেমন প্রসিদ্ধি লক্ষ্মী আরাধনায়। খালনাকে বলা হয় ‘লক্ষ্মীর গ্রাম’। হাওড়ার জয়পুরের খালনা বছরভর অপেক্ষা করে লক্ষ্মীপুজোর জন্যই। রাত পোহালেই লক্ষ্মীপুজো। গোটা গ্রাম সেজে উঠবে আলোকমালায়। যেন কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদের আলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে খালনা। হাতে গোনা কয়েকটি দুর্গা পুজো হলেও ধনদেবী লক্ষ্মীই এই গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সারা গ্রামে প্রায় ৪০টি বারোয়ারি লক্ষ্মীপুজো হয়। যার মধ্যে অন্ততপক্ষে ২০টি বিশাল বাজেটের থিমের পুজো। ফি বছর বন্যায় সর্বস্বান্ত হওয়া কৃষকরা লক্ষ্মীদেবীর কৃপার আশায় আজ থেকে প্রায় আড়াই-তিনশ বছর আগে পশ্চিম খালনা এলাকায় চারুময়ী লক্ষ্মী পুজো করেন। তারপর থেকেই এই গ্রামে লক্ষ্মীর আরাধনা শুরু হয়। গত তিন দশক ধরে শুরু হয়েছে থিমের পুজো। এলাকার মানুষও এখন শিধুমাত্র কৃষি কাজের উপর নির্ভর করে না, স্বর্ণ, লৌহ ও অন্যান্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করছেন। তাঁদেরও বিশ্বাস, লক্ষ্মী দেবীর কৃপাতেই কৃষিকাজে ভরাডুবির পর তাঁরা ব্যবসায় সমৃদ্ধি লাভ করেছেন।
সবাই যখন দুর্গাপুজো নিয়ে মেতে থাকেন তখন হলদিয়ার কিসমত শিবরামনগর, চাউলখোলার বাসিন্দারা প্রস্তুতি নেন লক্ষ্মী পুজোর। কারণ দুর্গা পুজো মিটলেই শুরু হবে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা। আর সেটাই এই এলাকার দুর্গাপুজো। এখানে লক্ষ্মী পুজোতেই নতুন জামা প়রেন এলাকার বাসিন্দারা, কাজের সূত্রে বাইরে থাকা মানুষরা ফেরেন ঘরে। পাশাপাশি দুটি গ্রামে ৭টি সর্বজনীন লক্ষ্মীপুজো সেখানে শেষ। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো হলেও হলদিয়ায় তার ব্যতিক্রম। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার পূর্ব পুরুষরা লক্ষ্মী পুজো করে আসছেন। পরবর্তী প্রজন্ম সেই ধারা বজায় রেখেছে। আগে ছোট আকারে পুজো হত।এখন তা ধীরে ধীরে বড় আকার নিয়েছে।
রায়গঞ্জ লাগোয়া টেনহরি গ্রামেওে দুর্গাপুজো নিয়ে মাতামাতি থাকে না। বাসীন্দাদের যত আবেগ লক্ষ্মীপুজোয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতেই গ্রামবাসীরা নতুন জামা পড়েন। হয় প্রতিমার প্রতিযোগিতা। বছরের সেরা উৎসবে মেতে ওঠে টেনহরি। হেমন্তের শুরুতে এখন মাঠ জুড়ে ধান। লক্ষ্মীর আরাধনাতেই গ্রামের শ্রীবৃদ্ধি। ভাল করে দেবীর পুজো করলে ফসল ভাল হবে। এই বিশ্বাসে গত ষাট বছর ধরে লক্ষ্মীর পুজো হয়ে আসছে এই গ্রামে। এখানকার লক্ষ্মী প্রতিমার বিশেষত্ব, লক্ষ্মী-নারায়ণের পাশে থাকেন সখী জয়া ও বিজয়া। আর লক্ষ্মীর সামনে গরুর পাখি। পুজো উপলক্ষে মেলা হয়। গ্রামের গৃহস্থদের বাড়ির প্রতিমা নিয়ে হয় প্রতিযোগিতা। বহু বছর আগে পূর্ব বাংলার লোকেরা এই টেনহরি অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন ওই এলাকায় তেমন ফসল ফলত না। একবার লক্ষ্মীপুজো ধুমধুাম করে হয়। তারপরই শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে এলাকার জমি। সেই থেকে লক্ষ্মীই গ্রামবাসীদের প্রধান আরাধ্যা।
লক্ষী বন্দনায় মহাধুমের সঙ্গে মেতে ওঠেন তারকেশ্বরের নাইটা মালাপাহাড় পুর অঞ্চলের দু তিনটে গ্রাম। এখানেও দুর্গাপূজা নয় লক্ষী পূজাকেই উৎসব হিসাবে পালন করেন বাসিন্দারা। মূলত দুর্গা পুজো নিয়ে যখন ব্যস্ত থাকেন বাংলার মানুষ তখন নাইটা মালাপাহারপুর অঞ্চলের রানাবাঁধ, বেড়েমুল, নাইট গ্রামের মানুষ ব্যস্ত থাকেন লক্ষী পুজোর আয়োজন নিয়ে। তিনটি গ্রামের ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ষোলটি ক্লাব লক্ষী পূজার আয়োজনে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন পুজোর দুই মাস আগে থেকেই।প্রতিটি ক্লাবের সদস্যরা নিজেরাই তৈরি করেন প্রতিমা, মণ্ডপ। প্রতিটি মণ্ডপেই থিমের বৈচিত্র চোখে পড়ার মতো। গত ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর ধরে এই রীতি চলে আসছে এই গ্রামগুলিতে। পুজো উপলক্ষে ছ’দিন ধরে চলে মেলা। প্রতিদিন প্রায় এক থেকে দেড় লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। শুধু তারকেশ্বর নয় অন্য অঞ্চল থেকেও ভিড় জমে এই লক্ষীপুজোয়৷