এ দেশে ১৯৭৬ সালে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল গুজরাটের পাঁচ লক্ষ দুধ খামারির দেওয়া দু’টাকা করে চাঁদায়। চাঁদায় তৈরি হওয়া সেটাই প্রথম ভারতীয় সিনেমা যেটি ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় তৈরি করেছিল। শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মন্থন’ আবর্তিত হয়েছিল দুগ্ধ সমবায় আন্দোলনের সূচনাকে কেন্দ্র করে। পরবর্তীতে এই সিনেমায় দেখানো দুগ্ধ সমবায় আন্দোলনের পথ ধরেই দুধের ঘাটতিতে থাকা দেশ ভারত দুধ উৎপাদনকারীতে শীর্ষস্থানীয়তে পরিণত হয়।
‘মন্থন’ সিনেমার কাহিনির অনুপ্রেরণা ছিল ভার্গিস কুরিয়েনের জীবন। দেশের দুধ উৎপাদনে বিপ্লন ঘটিয়ে দেওয়া এই মানুষটি বিখ্যাত ‘মিল্কম্যান অফ ইন্ডিয়া’ নামে পরিচিত ছিলেন। ছবিটি তৈরি হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পর ১৭ মে কান চলচ্চিত্র উৎসবে জাঁ-লুক গদার, আকিরা কুরোসাওয়া ও উইম ওয়েন্ডারসের ক্লাসিক চলচ্চিত্রের সঙ্গে রেড কার্পেট ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হল। চলচ্চিত্র নির্মাতা, আর্কাইভিস্ট ও পুনরুদ্ধারকারী শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুরের জানান, ছবিটি রিস্টোর করাটা ছিল চ্যালেঞ্জিং কাজ। কারণ ‘মন্থন’ সিনেমাটির ক্ষতিগ্রস্ত একটি নেগেটিভ ও দুটি বিবর্ণ প্রিন্ট টিকে ছিল। ছত্রাক পড়ে নেগেটিভটি অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, দাগ পড়ে গিয়েছিল অনেক জায়গায়। আর সাউন্ড নেগেটিভ তো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফলে বেঁচে যাওয়া একমাত্র প্রিন্টটির সাউন্ডই ছিল পুনরুদ্ধারকারীদের ভরসা।
পুনরুদ্ধারকারীরা ওই নেগেটিভ আর একটি প্রিন্ট উদ্ধার করেন। ওই প্রিন্ট থেকে সাউন্ড নিয়ে সেটি ডিজিটালাইজ করে ফিল্মটি মেরামত করেন তারা। পরিচালক শ্যাম বেনেগাল ও তাঁর সিনেমাটোগ্রাফার গোবিন্দ নিহালানির তত্ত্বাবধানে স্ক্যানিং ও ডিজিটাল ক্লিন-আপ করা হয় চেন্নাইয়ের একটি ল্যাবে ও ইতালির এক ফিল্ম রিস্টোরেশন ল্যাবে। প্রায় ১৭ মাস কাজ করার পর আল্ট্রা হাই ডেফিনিশন ফোরকে-তে পুনর্জন্ম হয় ‘মন্থন’-এর। পরিচালক শ্যাম বেনেগাল জানান, ভার্গিস কুরিয়েনের জীবন ও কর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি অপারেশন ফ্লাড (ভারতের দুধ বিপ্লব) এবং গ্রামীণ বিপণন উদ্যোগের ওপর বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন। তিনি যখন আরও বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য কুরিয়েনকে একটি পূর্ণ দৈর্ঘের সিনেমা বানানোর প্রস্তাব দেন, কুরিয়েন তাতে রাজি হননি, কারণ ছবিটি বানানোর টাকা নেই।
সমবায় মডেলের আওতায় ক্ষুদ্র কৃষকেরা গুজরাটের সংগ্রহকেন্দ্রের নেটওয়ার্কে সকাল ও সন্ধ্যায় দুধ নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। সেখান থেকে মাখনসহ অন্যান্য পণ্য তৈরির জন্য ওই দুধ পাঠানো হতো ডেইরিতে। কুরিয়েন প্রস্তাব দিলেন, সংগ্রহকেন্দ্রগুলি প্রত্যেক কৃষকের কাছ থেকে দু’টাকা করে কেটে নেবে। এতে কৃষকেরাই হয়ে যাবেন এই সিনেমার প্রযোজক। এরপর কৃষকদের কাছ থেকে তোলা টাকায় তৈরি হয় ‘মন্থন’। বেনেগাল বলেন, কৃষকেরা ‘মন্থন’-এর গল্প শুনে চাঁদা দিতে রাজি হন। ‘মন্থন’-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন গিরিশ কার্নাড, স্মিতা পাতিল, নাসিরুদ্দিন শাহ, অমরিশ পুরি, কুলভূষণ খারবান্দা ও মোহন আগাশে। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার বিজয় টেন্ডুলকার ও শ্যাম বেনেগাল। সংগীত পরিচালনা করেন বনরাজ ভাটিয়া।
‘মন্থন’ প্রথমে গুজরাটে মুক্তি পায় এবং সেখানে দারুণ সাড়া মেলে। তখন ছবিটির প্রযোজকেরাই ছিলেন দর্শক। ছবিটি দারুণ সারা পায় সেকারণেই। তখন ট্রাক ভর্তি করে মানুষ আসতো ছবিটি দেখতে। ৩৫ মিলিমিটার থেকে ৮ মিলিমিটার, সুপার এইট, পরে ভিডিও ক্যাসেট ফরম্যাটেও ‘মন্থন’-এর কপি হয়। ভারতে আর কোনো সিনেমার এতগুলো ফরম্যাটের কপি হয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ‘মন্থন’ দেখানো হয়। আর দেশে ছবিটি পায় জাতীয় পুরস্কার। ‘মন্থন’-এর সাফল্যে কুরিয়েনের মাথায় নতুন ভাবনা আসে। দুগ্ধ বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এই ছবিকে কাজে লাগান। দেশজুড়ে গ্রামে গ্রামে ‘মন্থন’-এর ১৬ মিলিমিটারের প্রিন্ট বিতরণ করেন তিনি। কৃষকদেরকে তাদের নিজস্ব সমবায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। রুপালি পর্দার অনুকরণে বাস্তবেও তিনি কৃষকদের মধ্যে ছবিটি বিতরণ ও প্রদর্শনের জন্য একজন পশুচিকিৎসক, একজন দুধ প্রযুক্তিবিদ ও একজন পশুখাদ্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি দল পাঠান।
‘মন্থন’-এর বাজেট ছিল কম। আর ৪৫ দিনে শুটিং শেষ করা ছিল বড় চালেঞ্জ। সিনেমার কুশীলবেরা গ্রামে একটি যৌথ পরিবার হিসেবে থাকতেন। গ্রামটির অনেক বাসিন্দাও ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। শুটিংয়ের পুরো সময়ে অভিনেতারা কস্টিউম বদলাননি, যাতে পোশাকগুলোকে বহুল ব্যবহারে জীর্ণ দেখায়। পরিবর্তন ঘটানোর জন্য সিনেমা যে কতটা শক্তিশালী’ ‘মন্থন’ সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। ছবিটি আজও আশ্চর্যভাবে সমান প্রাসঙ্গিক। কারণ এতে এমন সব ইস্যু উঠে এসেছে যা এখনো ভারতে বর্তমান। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মন্থনের প্রদর্শনিতে উপস্থিত ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, রত্না পাঠক শাহ, প্রয়াত স্মিতা পাটিলের ছেলে প্রতীক বব্বর, ভার্গিস কুরিয়েনের মেয়ে নির্মলা কুরিয়েন, স্মিতা পাটিলের বোন-অনিতা পাটিল প্রমুখ।