শিল্প আর শিল্পকর্ম এই দুই নিয়েই ছিল তাঁর জীবন এই দুটির জন্য তিনি। এছাড়া জগতের অন্য কোনো বিষয়বস্তুতেই তার তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। আর থেকে থাকলেও তা শিল্পের নেশার কাছে নেহাত তুচ্ছই ছিল। শান্তিনিকেতনে যখন কাজ জুটলো তখন তাঁর বেতন ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। তবে ভাস্কর্যে আধুনিকতার মাত্রা নতুনভাবে সংযোজনে যিনি অবিস্মরণীয়, তিনি অবশ্যই রামকিঙ্কর বেইজ। স্বশিক্ষিত এই ভাস্কর যেভাবে আধুনিক ধাঁচকে বেছে নিয়েও নিজের সংস্কৃতিকে আগলে রেখেছিলেন, তেমনটা আর কারও পক্ষে বলতে গেলে সম্ভবই হয়নি। সারাটা জীবন কেটেছে তার শান্তিনিকেতনে। কিন্তু ঔপনিবেশকতার বাতাস তাঁর গায়ে তেমন একটা লাগেনি। শান্তিনিকেতনে থেকে স্বশিক্ষায় ব্যক্তিগত প্রতিভা আর মননের জোরে ভারতীয় ভাস্করদের মধ্যে তিনিই প্রথম আধুনিকতার একটা মাত্রা সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আধুনিকতাকে বেছে নিলেও নিজস্ব কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে মোটেও ভুলে যাননি রামকিঙ্কর। বরং আধুনিকতার সঙ্গে আঞ্চলিক বা একেবারে নিত্যকার ভারতীয় জীবনকে মিশিয়ে এমন এক শিল্পকর্ম তৈরি করেছিলেন তিনি, যা ভারতবর্ষের শিল্পের ইতিহাসে বিরল। তার মতো আধুনিকতার ছাঁচে ভারতীয় ঘ্রাণের এমন শিল্পকর্ম কেউই তৈরি করতে পারেননি। শান্তিনিকেতনে ‘ফাউন্টেন’ নামে যে ভাস্কর্য সেটি মূলত একটি পদ্মপুকুরে দুটি মহিষের সম্মিলিত রূপ। মহিষের লেজ দুটি এমনভাবে নড়ছে যেন জীবন্ত দুটি মাছ। একটি প্রাণীর ফর্মকে রামকিঙ্কর দুটি প্রাণীর সম্মিলিত রূপে সাজিয়েছেন। আবার একইসঙ্গে কাজটিতে একটি ঝর্ণাও শোভা পাচ্ছে। কথিত, একবার গ্রীষ্মের খরতাপে পুকুরে এক মহিষকে নিজের লেজ দিয়ে গায়ে জল ছিটানোর দৃশ্য দেখে মহিষের লেজটাকে রামকিঙ্করের মাছের মতো মনে হয়, যেন দুটি অসংলগ্ন বস্তু কী দারুণ প্রাকৃতিক স্বাচ্ছন্দ্যে মিশে গিয়েছে। একটা মহিষ আর তার লেজ, এই পুরো বিষয়টাই দারুণভাবে রামকিঙ্করের মনে দাগ কাটে।
ভারতবর্ষের শিল্পের ইতিহাসে ভাস্কর্যশিল্পের এক নতুন ধারার প্রচলন করার ক্ষেত্রে রামকিঙ্কর বেইজ অনন্য। জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সেই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা নতুন শৈলী সৃষ্টিতে তাঁকে দারুণভাবে সাহায্য করেছিল। এর পিছনে পরোক্ষভাবে প্রভাব ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নন্দলাল বসুর। তাছাড়া শান্তিনিকেতন ছিল ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত। শান্তিনিকেতনে শিল্পচর্চা বিকাশ লাভ করেছিল ভারতীয় কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে।যদিও সেই সময় ভাস্কর্য গড়ার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও এত সহজলভ্য ছিল না। উপরন্তু, ভাস্কর্য বিভাগ থেকেও বড় কাজ করার পেছনে অর্থ সহায়তা তেমন ছিল না; তাছাড়া, নন্দলাল বসু চিত্রকলার প্রতিই বেশি অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু নাপিতের ঘরে জন্ম নিয়েও যেমন থেমে থাকেনি রামকিঙ্করের শিল্পক্ষুধা, তেমনি শত বাধা পেরিয়েও তিনি ভাস্কর্য নির্মাণ করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজস্ব সংস্কৃতিকে যেন লোকে ভুলে না যায়, সেজন্য রামকিঙ্কর পোড়ামাটির কাজ দিয়ে ঘরবাড়ি থেকে শুরু সবকিছু সাজানোর কথা বলতেন। ঔপনিবেশকতা আর পাশ্চাত্যের চাপে পড়ে নিজস্বতা যাতে হারিয়ে না যায় এবং একইসঙ্গে শিল্পের পথে যে জড়ত্ব রয়েছে, তা যেন ভেঙে ফেলা যায়- মূলত এটাই ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গি। আধুনিক ধারার শিল্পকর্ম করলেন বটে রামকিঙ্কর বেইজ, কিন্তু সেটা পাশ্চাত্য ধাঁচে নয়, বরং নিজেদের চিরচেনা রূপ আর রঙে।
রামকিঙ্কর বেইজের কাজের ধরন একদমই স্বতন্ত্র এবং তাতে ঐতিহ্যের প্রতিফলন পাওয়া যেত। যা ভারতের শিল্পে আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। এমন নয় যে তিনি তার ভাস্কর্যশৈলীর জন্যই বিখ্যাত, তার চিত্রকর্মও বেশ প্রাণবন্ত আর একদমই স্বতন্ত্র ধারার। স্বতঃস্ফূর্ত আর সাহসী চিত্রকর্মের জন্য তার চিত্রকর্মগ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে বেশ প্রসংশাও কুড়িয়েছিল। শান্তিনিকেতনে তিনিই প্রথম তেলরঙের চিত্রকর্মের কাজ শুরু করেছিলেন। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা আর বিতর্কেরও শেষ ছিল না। প্রথম প্রথম তো তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নন্দলাল বসুও আপত্তি করেছিলেন। পরে ছাত্রের কাজের ধরন দেখে তার আপত্তি ‘নেই’ হয়ে যায়। পিকাসো আর সেজানের চিত্রকর্মগুলো তাকে ব্যাপক আগ্রহ জাগাত। তাঁর চিত্রকর্মে পিকাসোর কিউবিস্ট ধারার একটা ছাপ লক্ষ করা যায়, তবে সেটা একদমই আলাদা আর স্বতন্ত্র ধারার। রামকিঙ্কর এমন একজন শিল্পী ছিলেন, যিনি শুধু কাজের সন্ধানে শিল্পের দর্শনেই নিজের পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন। সাফল্য, খ্যাতি এবং অর্থকড়ি- জাগতিক সবকিছুর প্রতিই ছিল তার অবাধ উদাসিনতা।