ফলের রাজা আম নিয়ে ‘আ হিস্টোরিক্যাল ডিকশেনরি অফ ইন্ডিয়ান ফুড’ জানাচ্ছে, পর্তুগিজরা এদেশে প্রথম আমচাষ শুরু করেছিল। তবে যেখানে প্রথম আম চাষ শুরু হয় সেটি তখন ভারতের অংশ হলেও বর্তমানে মায়ানমারের অংশ।পর্তুগিজদের হাত ধরে সেদিন প্রথম জন্ম নেওয়া আমের নাম ছিল ফর্নান্দিন। সুস্বাদু এই ফলটি অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেটেরও খুব পছন্দ হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে গ্রিস ফেরত যাওয়ার সময় তিনি বেশ কিছু আম সঙ্গে নিয়েছিলেন। পর্তুগিজরাও ফেরত যাওয়ার সময় আমের বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল, তারপরই নাকি দেশে-বিদেশে আমের ফলন শুরু হয়।
ভারতে মুঘল যুগের আগে থেকেই আমের চাহিদা ছিল তবে মুঘলরা আসার পর থেকে আমের চাষ বাড়তে থাকে। জানা যায়, তোতাপারি, কেশর, রাতাউলের মতো আম মুঘল আমলে দেখা যেত। আর সেই সময় থেকেই আমকে উপহার হিসাবে দেওয়ার রীতি শুরু হয়েছিল। তবে মুগল আমলে আম শুধুমাত্র রাজ পরিবারের বাগানেই চাষ হত। সম্রাট শাহজাহান রাজ পরিবারের বাইরে আমের চাষ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কথিত, মোগল সম্রাট আকবর ভারতের শাহবাগের দাঁড়ভাঙায় এক লক্ষ আমের চারা বসিয়ে এই উপমহাদেশে প্রথম একটি উন্নত আম বাগান তৈরি করেছিলেন।
আমের বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা, সংস্কৃতে আম্র, বাংলায় আম, ইংরেজিতে ম্যাংগো, তামিল ভাষায় ম্যাংকে, রামায়ণ ও মহাভারতে আম্রকানন এবং আম্রকুঞ্জ শব্দের দেখা মেলে।ধারণা করা হয়, আম প্রায় সাড়ে ৬০০ বছরের পুরনো। যদিও আমের জন্মস্থান নিয়ে রয়েছে নানা তর্ক-বিতর্ক। বৈজ্ঞানিক ‘ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা’ নামের এ ফল ভারতীয় অঞ্চলের কোথায় প্রথম দেখা গেছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই জনপদই যে আমের আদিনিবাস তা নিয়ে সবাই একমত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই অঞ্চলে ভ্রমণে এসে বাংলাদেশের আমকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করেন। ১৩৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে আফ্রিকায় আম চাষ শুরু হয়। এরপর ১৬ শতাব্দীতে পারস্য উপসাগরে, ১৬৯০ সালে ইংল্যান্ডের কাচের ঘরে, ১৭ শতাব্দীতে ইয়েমেনে, উনবিংশ শতাব্দীতে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে আম চাষের খবর পাওয়া যায়। ১৮৬৫ সালে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাটিতে প্রথম আমের আঁটি থেকে গাছ হয়। এভাবেই আম বিশ্ববাসীর দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়।
বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আমের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাংলার প্রাচীন গ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আম হল আমবু, ভারতচন্দ্রে আম, ঈশ্বর গুপ্তে আঁব, মাইকেল মধূসূন অভিহিত করেছেন রসাল নামে। মৎস্যপুরাণ ও বায়ুপুরাণে কালো আমের উল্লেখ আছে, আম বা আম্র শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘সুখে ভোগ করা। বাৎস্যায়ন আমকে ‘সহকার’ বলেছেন। আমকে আরবিতে ‘আম্বাজ’ও ফারসিতে ‘আম্বা’বলা হয়। মুঘল সম্রাট বাবর ও চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং আমকে যথাক্রমে ‘পোর-ই-হিন্দ’ও ‘প্রিন্স অব ফ্রুট’বলতেন। আমের অন্যান্য প্রতিশব্দ—মাকন্দ, মদির, সখ, কামাঙ্গ, সরস, মধুদূত, অঙ্গনপ্রিয়, পিকবল্লভ, মৃষালক ইত্যাদি। আম যে এই উপমহাদেশেরই ফল, তা স্বীকার করেছেন ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, ইবনে বতুতা-সহ অনেকে। আকবরই প্রথম আমের গুণে সরকারি সিলমোহর দেন। তিনিই দ্বারভাঙার নিকটে ‘লাখবাগ’বাগানে এক লাখ বিভিন্ন প্রজাতির আমের চারা লাগিয়েছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে আইন-ই-আকবরিতে আমের প্রজাতি-বিচিত্র লিপিবদ্ধ করা হয়।
আম জড়িয়ে আছে বাংলার স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে যে বেদনার ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল, ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয় এই আম্রকাননে। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে… ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে, ঘ্রাণে পাগল করে…’। এখানে আমগাছের উপস্থিতি দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ। আমগাছ চিরসবুজ, সুদর্শন ও দীর্ঘজীবী। আম আমাদের সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। আমপাতা হিন্দু ও বৌদ্ধরা ধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চায় বহুলভাবে ব্যবহার করে। আম আমাদের সাহিত্য ও লোকগাথায় নিবিড়ভাবে যুক্ত। বাংলা সাহিত্যে যেমন আম নিয়ে গল্পের শেষ নেই, তেমনি লোক-ইতিহাসেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীথিকার নিমন্ত্রণ কবিতায় লিখেছেন, ‘বেতের ডালায় রেশমি-রুমাল–টানা / অরুণবরন আম এনো গোটাতক।’নারী জ্যোতিষী খনার বচনে বলেছেন, ‘মাঘে বোল, ফাগুনে গুটি, চৈত্রে কাটিকুটি, বৈশাখে আটি, জ্যৈষ্ঠে দুধের বাটি। খনার এই প্রবচনটি ছিল বাংলাদেশে আমের মুকুল ধরা থেকে শুরু করে আম পাকা এবং দুধ-মিষ্টি দিয়ে আম খাওয়ার সময়সীমা।
নানা নামের, বিচিত্র স্বাদের ও রঙের অজস্র আম নিয়ে বোশেখ থেকে আষাঢ় চলে মাতামাতি। হিমসাগর, গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাতি, মল্লিকা, চন্দনকসা, ফজলি, ল্যাংড়া, গোলাপ খাস, বোম্বাই, চম্পা, শাদুল্লা, আনারস, লক্ষ্মণভোগ, বিমলি, পেয়ারা ফুলি, আম্রপালি, বিড়া। এর বাইরে যেসব আম পাওয়া যায়, সেগুলি এলাকাভিত্তিক জনপ্রিয় আম যেমন— রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা, দিনাজপুরের সূর্যমুখী, আসামের সিন্দুরি, কেতুরি, বিহারের জরদালু, সুকুল, মিঠিয়া, উত্তর প্রদেশের চৌসা, দসেরি, অন্ধ্রের বানাগানাপল্লি, কন্নড়ের তোতাপুরি, গুজরাটের কেশর এবং অবশ্যই মহারাষ্ট্রের আলফান্সো!