উপনির্বাচনে সাধারণত ভোট শাসকের পক্ষেই থাকে। সাধারণ নির্বাচন এবং উপনির্বাচনের পার্থক্য হল উপনির্বাচন থেকে সরকার বদল যেমন হয়না কেবলমাত্র বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়কের শূন্যস্থান পূরণ হয়। ফলে ভোট শাসকদলের পরিবর্তে বিরোধী বা অন্যদলে পড়ার সম্ভবনা থাকেনা বলা যায়। কারণ ভোটারাও জানেন মাত্র কয়েকটি কেন্দ্রে নতুন করে শাসক দলের পরিবর্তে বিরোধি বা অন্যদলকে নির্বাচিত করে বিশেষ কোনো লাভ হয়না তার চেয়ে সরকারে যারা রয়েছেন সেই দলের পক্ষে ভোট দেওয়াটাকেই তারা যুক্তিযুক্ত মনে করে। তবে এই প্রবণতাই যে সব সময়ে সত্যি তাও নয়, অনেক সময়েই এর অন্যথা ঘটেছে। অর্থাৎ উপনির্বাচন মানেই শাসকদল জিতবে, এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। প্রসঙ্গত ২০০৯ সালে; তখনও পর্যন্ত রাজ্যে শাসকের আসনে বামেরা জমানায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর পশ্চিম কেন্দ্রে সিপিএমের বিধায়ক রথীন সরকারের মৃত্যুর কারণে উপনির্বাচন হয় তৃণমূলের মদন মিত্র সিপিএম প্রার্থী ইস্কান্দার হোসেনকে পরাজিত করেন। জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ কেন্দ্রেও জিতেছিল তৃণমূল প্রার্থী খগেশ্বর রায়। তার আগে এই কেন্দ্রের আসনটি ছিল সিপিএমের দখলে। পূর্ব বেলগাছিয়া কেন্দ্রে সিপিএমের দাপুটে মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর মৃত্যুর পরে উপনির্বাচনে সুভাষ-জায়া রমলা চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে সুভাষ চক্রবর্তীর স্নেহধন্য সুজিত বসু তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে জিতেছিল। অন্যদিকে তৃণমূল জমানাতেও শাসকদলের আসন বিরোধীদের কেড়ে নেওয়ার নজির রয়েছে। ২০১৯ সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া সাংসদ অর্জুন সিংহের ছেড়ে যাওয়া ভাটপাড়ার আসনে বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন তাঁর পুত্র পবন সিংহ। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীকে পরাস্ত করেন সিপিএম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস জিতে রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলেছিলেন। যদিও তিন মাসের মধ্যেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বাইরনকে তৃণমূলে নিয়ে আসেন।
রাজ্যের ছ’টি বিধানসভা আসনে আগামী ১৩ নভেম্বর যে উপনির্বাচন হবে ওই ঠিক হয়ে গিয়েছিল গত ৪ জুন লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরেই। কারণ, লোকসভা ভোটে বিজেপি দল থেকে এক জন এবং তৃণমূল থেকে পাঁচ বিধায়ক সাংসদ হন। একুশের বিধানসভার ফল অনুসারে উপনির্বাচনের ছ’টি আসনের মধ্যে পাঁচটি আসনই ছিল শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে, মাত্র একটি আসন ছিল বিরোধী দল বিজেপির দখলে। সেই আসনটি হল উত্তর বাংলার আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট। এই আসনটি বিজেপির পক্ষে একমাত্র পাকা আসন বলাই যায় কারণ, ২০১৬ এবং ২০২১ সালে এই আসনে বিজেপির মনোজ টিগ্গা জিতেছিলেন। তিনি এখন আলিপুরদুয়ারের সাংসদ বিধানসভায় বিজেপির মুখ্য সচেতক। কেবলমাত্র গত লোকসভা নির্বাচন নয়, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভাতেও মাদারিহাট বিধানসভায় বিজেপির অবস্থান ছিল এক নম্বরে। উত্তরবঙ্গের আরও একটি আসনে উপনির্বাচন রয়েছে, সেটি কোচবিহার জেলার সিতাই। এই কেন্দ্রে তৃণমূলের জগদীশচন্দ্র বসুনিয়া বিজেপির দিলীপকুমার রায়কে ১০ হাজার ১১২ ভোটে হারিয়েছিলেন। গত লোকসভা ভোটে কোচবিহার কেন্দ্রে জিতে বসুনিয়া এখন সাংসদ। উত্তর ২৪ পরগনার দুটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন। একটি বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের নৈহাটি। এই কেন্দ্রে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের জেতার হ্যাটট্রিক রয়েছে। এখন তিনি তৃণমূলের লোকসভার সাংসদ। এই জেলার আর এক কেন্দ্র হাড়োয়া। এখানকার তৃণমূল বিধায়ক হাজি নুরুল গত লোকসভা নির্বাচনে সন্দেশখালির উত্তাল পরিস্থিতিতেও বসিরহাটে জয় পেয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও ছিল নারী নির্যাতনের অভিযোগে। নুরুলের প্রয়াণে বিধানসভা ও লোকসভা দুটি আসনই শূন্য। এছাড়া রয়েছে মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়ার তালডাংরা।
প্রশ্ন এমন একটা সময়ে রাজ্যের ছ’টি কেন্দ্রে উপনির্বাচন হতে চলেছে যে সময় আরজি কর হাসপাতালের নির্যাতিতার ধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল। এই আবহে সামান্য হলেও অস্বস্তি বেড়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের। কারণ, ঘটনার প্রতিবাদে টানা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ চলছে রাজ্যে। এর প্রভাব কি উপনির্বাচনে পড়বে? বিশেষঙ্গদের মতে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল থাকলেও আরজি কর ইস্যুর প্রভাব মূলত শহরকেন্দ্রিক। মফস্বল বা গ্রামীণ ভোটারদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব সেভাবে পড়বে না। আর সেই কারণেই বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কৌশলে আঞ্চলিক বিষয়গুলিকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া। সেক্ষেত্রে ভোটের প্রচারে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প যেমন স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পগুলির দিকে। আরজি কর-কাণ্ডের পরে এই ভোটে লড়াই মূলত বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের। সিপিএম-কংগ্রেস খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু যে ভোট বিজেপির কাছে লোকসভা ভোটের পর ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই হতে পারত সেখানে প্রার্থীতালিকা ঘোষণার পরেও তাদের তেমন উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে মাদারিহাট ধরে রাখতে পারলেই যথেষ্ট। সবার আগে প্রার্থী ঘোষণা করলেও এখনও পর্যন্ত বিজেপির তেমন কোনও হেলদোল নেই। শাসক তৃণমূল এই জায়গাটাতে সাংগঠনিক ভাবে বিজেপির থেকে এগিয়ে আছে। আরজি করের আন্দোলন প্রসঙ্গে বলা যায় বলা যায় সন্দেশখালিতে প্রতিবাদ হয়েছিল কিন্তু তার প্রভাব লোকসভা ভোটে পড়েনি। অন্যদিকে বাম ও কংগ্রেসের প্রার্থীরা যে লড়াইতে আছেন সেটাও স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। উত্তরবঙ্গের যে দুটি আসনে উপনির্বাচন সেখানে আরজি করের ঘটনা আদৌ কোনো ইস্যু হবে বলে মনে হচ্ছে না কারণ, আন্দোলনের ঝাঁজ এখন কেবল কলকাতা ও আশেপাশে। বাকি যে কেন্দ্রে উপনির্বাচন, সেখানে বিরোধীরা ওই আন্দোলনের বিষয়টি সেখানকার মানুষদের সামনে উপনির্বাচনে ইস্যু করে তুলতে পারেন নি। তাই এই নির্বাচনে আরজি কর আন্দোলন প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। বরং উপনির্বাচনে ৬টি আসনেই জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী রাজ্যের শাসকদল।