‘ইউর লাভ বেটার দ্যান আইসক্রিম’ গায়িকা সারাহ ম্যাকলাচলান গানের কথায় যাই বলুননা কেন, সত্যিই কি এমন কোনো খাবার আছে যার সঙ্গে আইসক্রিমের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের তুলনা করা যায়। ইতালিয়ানরা আইসক্রিমকে বলেন জেলেতো, ফরাসিরা বলেন গ্লেস, রাশিয়ানরা বলেন মোরোজেনো। টোকিও থেকে তুরস্ক গোটা দুনিয়ায় এমন মানুষ নেই যে আইসক্রিম পছন্দ করে না। আইসক্রিম নিয়ে গল্প-কথার শেষ নেই- আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট নাকি মধু মাখানো বরফ খেতে পছন্দ করতেন। বাইবেলে আছে, রাজা সলোমন বরফ কুচি মেশানো পানিয়ের ভক্ত ছিলেন। রোমান সম্রাট নিরো ক্লডিয়াস সিজার প্রায়ই লোক পাঠাতেন পাহাড়ের বরফ কুড়িয়ে আনতে, তারপর তা ফলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে খেতেন। এরও অনেক অনেক বছর পর আমেরিকায় আইসক্রিমের প্রথম বিজ্ঞাপন বের হয় নিউ ইয়র্ক গেজেটে, ১৭৭৭ সালে। তা সত্ত্বেও বলা হয়, মোগলরাই পৃথিবীকে প্রথম আইসক্রিম উপহার দিয়েছে।
আইসক্রিমের সঙ্গে নানা ঘটনার আকর্ষণীয় ইতিহাস জড়িয়ে আছে। যার মধ্যে চীনের সম্রাট থেকে ইংরেজ রাজা যেমন আছেন তেমনি আছেন ক্রীতদাস, ব্যবসায়ী, আমেরিকায় ইতালীয় অভিবাসীও। উচ্চবিত্তদের রসনার বাসনা পূরণ করার মধ্য দিয়ে আইসক্রিমের সূচনা হলেও কালে কালে এর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। আমজনতার নাগালের মধ্যেও এসে যায় এর মূল্যমান। কেউ বলেন, চীনে প্রথম দুগ্ধজাত উপাদানের হিমায়িত মিষ্টি খাদ্য আইসক্রিম চালু হয়েছিল। পাশাপাশি অনেকেই বলেন, আইসক্রিম বলতে যা বোঝায়, তা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ইউরোপ। প্রধানত ইতালি এবং ফ্রান্স, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের পর আমেরিকায় আইসক্রিম জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে যায় এবং সেখানে প্রিয় মিষ্টি খাবার হয়ে ওঠে। এমনও বলা হয়, গোটা বিশ্বে আইসক্রিমকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে বিশাল ভূমিকায় ছিলেন আমেরিকার ব্যবসায়ী মহল। আজকের দুনিয়ার নামকরা অনেক আইসক্রিম কোম্পানির শিকড় রয়েছে আমেরিকায়।
তবে আমেরিকার আইসক্রিম ইউরোপের রেসিপি এবং কৌশলের কাছে ঋণী হয়ে আছে। ইতালি, ফ্রান্স এবং ইংরেজ রন্ধন বিশারদ বা বাবুর্চিরা প্রাথমিক পর্যায়ে যে আইসক্রিম তৈরি করেছিল তার ধারাবাহিতকতা আজও রয়েছে। ইতালীয় অভিবাসীরা তাদের আইসক্রিম বানানোর দক্ষতা ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় নিয়ে আসে। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন এবং বার্লিনের মতো নগরীগুলোতে তারাই আইসিক্রম বিক্রেতার কাজ করে। এভাবেই আইসক্রিমকে রাস্তার খাবার হতে সাহায্য করে তারাই। আমেরিকার প্রভাব সত্ত্বেও স্থানীয় আইসক্রিমের ঐতিহ্য আজও টিকে আছে। ইতালির জেলেতো, তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু এলাকায় অর্কিডের শিকড় দিয়ে তৈরি বিশেষ আইসক্রিম, ইরানের বাস্তানিয়ে মাহাল্লি বা স্থানীয় আইসক্রিম এমনই এক ধারাবাহিকতা। জাফরান দিয়ে বানানো এই আইসক্রিমে দুপাশে বিস্কুটের মতো ওয়েফার থাকে। প্লাস্টিকের পাত্রেও বিক্রি হয় বাস্তানিয়ে মাহাল্লি। পাড়ায় পাড়ায় লাবানিয়াত বা দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রির দোকানে সারা বছরই পাওয়া যায়। তেহরানে তুষারপাতের সময় আইসক্রিম খাওয়ার মধ্যে একধরনের মজা খোঁজে অনেকে। ইরানে নানা পদের আইসক্রিম তৈরি হয়। তারপরও বাস্তানিয়ে মাহাল্লি টিকে আছে। সাধারণভাবে ইরানিরা ঝাল খায় না। দেশটিতে খাবারে মসলার ব্যবহারও খুব কম। সে দেশেও ঝাল আইসক্রিম তৈরি হয়েছিল কিন্তু সে উদ্যোগ জনপ্রিয় হয়নি।
প্রাচীনকালে ঠান্ডা পানীয় বানানো মোটেও সহজ ছিল না। বরফকে দীর্ঘ সময় ধরে ঠিক রাখাই ছিল সেকালের প্রধান সমস্যা। ফ্রিজ আবিষ্কারের আগে বরফের জন্য পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হত। সেই বরফ গলে যাতে জল হয়ে না যায়, তার ব্যবস্থা করতে হত। হাজার হাজার বছর আগে, মেসোপটেমিয়ার মতো অঞ্চলে বরফ সংরক্ষণের জন্য মানুষ বিশেষ বাড়ি বানাত। গ্রিক ও রোমানরা পাহাড় থেকে বরফ এনে বিশেষ গর্তে সংরক্ষণ করত। ইরানেও একই রকম চল ছিল। ফার্সিতে সাধারণ ফ্রিজকে ইয়াকচল বলা হয়। ইয়াক মানে বরফ, চল মানে গর্ত। সহজেই বোঝা যায় এমন নামকরণের উৎস কী! ১১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনের মানুষ খাবারকে তাজা রাখার জন্য বরফ সংগ্রহ করত। ৮৩৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রেত্রা জয় করেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তিনি বরফ সংগ্রহ করার গর্তের দেখা সেখানেই পেয়েছিলেন। চতুর্থ শতকে জাপানের সম্রাট নিনতোকু বরফের খাদ্য সংরক্ষণ ক্ষমতা জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি ১ জুন তারিখকে তার সাম্রাজ্যে জাতীয় বরফ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) সম্রাটরাই প্রথম আইসক্রিমের মতো বরফের খাবার উপভোগ করেন। যদিও এখকার আইসক্রিমের সঙ্গে সেই ঠান্ডা খাবারের মিল ছিল না। সেই আইসক্রিম তৈরি হত ছাগল, মহিষ বা গরুর গেঁজানো দুধ, ময়দা এবং কর্পূর থেকে।
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বরফ দেওয়া পানীয় জমাট মিষ্টিতে রূপ নেয়। চিনির সঙ্গে স্ট্রবেরি, লেবু বরফ যোগ করে তৈরি হতে থাকে এই খাদ্য। জমাট সেই মিষ্টিকে ‘সুরবেত্তো’ নাম দেওয়া হয়। মনে করা হয় এমন খাদ্য প্রথমে তৈরি হয় ইতালিতেই। নেপলসে স্প্যানিশ ভাইসরয়ের পাকশাল এবং খাদ্যবিষয়ক তত্ত্বাবধায়ক আন্তোনিও লাতিনি প্রথম ‘সুরবেত্তো’ তৈরির প্রণালি এবং পরিবেশনের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেন। নেপলসে কেবল অভিজাতরাই নয়, সাধারণ মানুষও ‘সুরবেত্তো’ পান করতেন। সেই এ পানীয়তে তিনি ফলের নির্যাসের সঙ্গে চকোলেটও যোগ করেন। ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে আইসক্রিমের কারখানা খুলেছিল। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের এতে জীবিকা উপার্জনের পথ খুলেছিল। তারা ফেরি করে আইসক্রিম বিক্রি করতেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরাও নিজেদের বাড়িতে কেক এবং আইসক্রিম তৈরি করতেন, আর স্থানীয় লোকেরা সেগুলো ফেরি করে বিক্রি করতেন।