বিল ক্লিনটনের প্রচার কৌশলবিদ জেমস কারভিল বলেছিলেন, আমেরিকার নির্বাচনে সবথেকে বেশি গুরুত্ব পায় অর্থনীতি আর বোকারা! এবারও সে দেশের ভোটাররা অন্য সব বিষয়ের থেকে আমল দিয়েছিল অর্থনীতিকেই। প্রচার, সমীক্ষা সবেতেই এবার আমেরিকানদের প্রায় অর্ধেকই বলেছিলেন, গত চারবছর ধরে তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়েই খারাপ অবস্থায় আছেন। অতএব সে দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসাবে অ্যামেরিকানরা কাকে বেশি পছন্দ করছেন তা তখনই বোঝা গিয়েছিল। তিনি যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্ সেটা স্পষ্ট চিল। শেষ পর্যন্ত তিনিই শেষ হাসি হাসলেন। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার তিনি প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। পরপর দু’বার নয় ঠিকই, তবে আমেরিকার ইতিহাসে এমন ভাবে ফিরে আসার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন আরেক জন, প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। তিনি ১৮৮৫ সালে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। পরের বারেও তিনি ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সেবার আর জনসমর্থন তিনি পাননি। ফের তিনি ১৮৯৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ঠিক একই ঘটনা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও দেখা গেল৷ ২০১৬ সালের নির্বাচনে জিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তিনি। ২০২০ সালের নির্বাচনে তিনি জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হয়ে হোয়াইট হাউস ছাড়তেই হয়েছিল কিন্তু ৪ বছর পরে ফের হোয়াইট হাউজের বাসিন্দা হলেন।
বিগত চার বছরে ক্যাপিটল হিলে হামলার মামলা, দুর্নীতি ও পর্নো তারকাকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ, সরকারি গোপন নথি চুরি ও ধ্বংসের অভিযোগ, শেষে নির্বাচনে আগে হত্যার একাধিক চেষ্টা- ট্রাম্প আলোচনায় ছিলেন প্রায় পুরোটা সময়েই। ট্রাম্পই প্রথম অভিযুক্ত অপরাধী যিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হলেন। প্রসঙ্গত, এডিসন রিসার্চ এর জাতীয় বুথফেরত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩১ শতাংশ ভোটার অর্থনীতির ইস্যুটিকে সবথেকে উপরে রেখেছে আর ৩৫ শতাংশ ভোটার দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ, অর্থনীতি দ্বিতীয় স্থানে কিন্তু যেসব ভোটারের কাছে অর্থনীতিই প্রধান উদ্বেগের বিষয় তারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। এই সংখ্যাটা ট্রাম্পের পক্ষে ৭৯ শতাংশ এবং হ্যারিসের পক্ষে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে, গত কয়েকবছর ধরে আমেরিকার মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভোটাররা উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে কেবল অর্থনীতি নয়, মূল্যস্ফীতির বিষয়টি ট্রাম্পকে জিততে সাহায্য করেছে। ভোটারদের অর্ধেকেরও বেশি জানিয়েছে, গতবছর তারা মূল্যস্ফীতির কারণে খুব দুরবস্থার মধ্যে পড়েছিল। তাছাড়া প্রায় চারজনের একজন আমেরিকানই বলেছে, মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের দিন কেটেছে মারাত্মক দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে। যে ভোটাররা মূল্যস্ফীতির কারণকে সামনে এনেছে তাদের অনেকেই যে ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছে সে কথা বলাই বাহুল্য। কেবল তাই নয়, খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যাপনের কথা বলা ৭৩ শতাংশ ভোটারও ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। এই জায়গা থেকে ট্রাম্পের পক্ষে পড়েছে ৮০ শতাংশ ভোট আর হ্যারিস পেয়েছেন ১৭ শতাংশ ভোট।
তবে এতসব সমীক্ষা ও বিশ্লেষণের পরবর্তী চার বছর যে ট্রাম্পের সঙ্গে উথাল-পাতাল যাত্রায় কাটাতে হবে সেকথাও বলছেন বিশেষঙ্গেরা। কারণ, ট্রাম্পকে ঘিরে রয়েছে অনেক নেতিবাচকতা। আমেরিকার গণতন্ত্র ট্রাম্পের হাতে কতটা নিরাপদ তা নিয়ে বার বার কথা উঠেছে। তার খামখেয়ালি আচার-আচরণ নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। ট্রাম্প আমেরিকার বিচার বিভাগে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত। এতসব প্রতিকূলতা নিয়েও নির্বাচিত ট্রাম্পকে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই প্রশ্নের পাশাপাশি আরেকটি কথাও উঠে আসছে, আমেরিকার ভোটাররা কমলা হ্যারিসকে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করলো না।তবে কি তারা এখনো একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে প্রস্তুত নয়? প্রার্থী হিসাবে কমলা অত্যন্ত উচ্ছল এবং উজ্জীবিত হয়েও হেরে গেলেন। কিন্তু কেন হারলেন?
তুলনায় হিলারির থেকে তিনি অনেক অনেক বেশি কর্মদীপ্ত। কিন্তু তারপরও পরাজিত হলেন। তবে কি ‘নারী-প্রতিবন্ধকতা’ বা গ্লাস সিলিং একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু এর বাইরেও অনেক ফ্যাক্টর আছে যা তার পক্ষে কাজ করেনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল, রিপাবলিকানদের ল্যাটিনো (হিস্পানিক) সমর্থন। যা অন্যবারের তুলনায় প্রতিটা অঙ্গরাজ্যে এবার অনেক বেড়ে গিয়েছে। যদিও তরুণী ভোটাররা কমলাকে বেশি সমর্থন দিয়েছেন কিন্তু তরুণেরা কমলাকে সেই ভাবে সমর্থন দেয়নি। আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণি আবার ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছে। কারণ, ট্রাম্প আমেরিকার অর্থনীতিকে চীনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুৰ্ভাগ্যবশত ডেমোক্র্যাটরা শুধু ট্রাম্পের খামখেয়ালি আচরণ নিয়েই প্রচার চালিয়েছে, ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিগুলো যে জনগণের সমর্থন পাচ্ছে, তা যাচাই করেনি। তরুণদের ভোট হারাবার প্রধান কারণ হল, গাজা যুদ্ধবিরোধী মনোভাব। কমলা বাইডেনকে ডিঙিয়ে গাজা যুদ্ধের সমালোচনা করতে পারেননি বা করতে চাননি। শুধু হোয়াইট হাউজ নয়, ডেমোক্র্যাটরা সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও হারিয়েছে। ট্রাম্প গাজা যুদ্ধ নিয়ে কী করবেন তা দেখতে মুসলিম বিশ্ব হয়ত অপেক্ষা করছে। কিন্তু ট্রাম্প কট্টর ইসরায়েলি সমর্থক। কিন্তু তিনি নিজেকে শান্তিবাদী ও যুদ্ধবিরোধী বলে প্রচার করে থাকেন। তাতে অনেকের ধারণা ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এবং গাজা নিয়ে একটা মীমাংসা করবেন।