জলের অপর নাম জীবন। কিন্তু জল হলেই হবে না, দরকার বিশুদ্ধ পানীয় জল। যে কোনো জল মানেই তা পানের যোগ্য নয়। তাছাড়া স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার কারণেই বিশুদ্ধ জল যেমন দরকার তার সঙ্গে জরুরি নিরাপদ স্যানিটেশন। কিন্তু সারা দুনিয়ার সব মানুষ কী বিশুদ্ধ পানীয় জল পান কিংবা নিরাপদ স্যানিটেশের আওতায় আছেন? না, বিশ্বের প্রায় ২৩০ কোটি মানুষের জন্য নেই বিশুদ্ধ পাণীয় জল এছাড়া বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষের জন্য নেই নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মানুষের মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ ছিল ডায়রিয়াজনিত অসুখ। একই সঙ্গে ওই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সারাবিশ্বে ২০১৯ সালে বিশুদ্ধ পানীয় জল ও নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। বিশেষ করে স্কুলের মেয়ে ও শিশুদের ওপর এর বিরাট প্রভাব ছিল।
গোটা বিশ্বে বিশুদ্ধ পানীয় জল ও নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবের পাশাপাশি আনুমানিক ৪৪০ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বিপজ্জনক জল পান করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত হল এমন একটি রিপোর্ট। উল্লেখ্য, প্রত্যেক মানুষের কাছে স্বচ্ছ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ সুস্থায়ী উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি করেছিল, যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে মানুষের কাছে সুলভে নিরাপদ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া। এই লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু অধিকার সংস্থা ইউনিসেফ-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি জয়েন্ট মনিটারিং প্রোগ্রাম ফর ওয়াটার সাপ্লাই, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন গবেষণা শুরু করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কেবলমাত্র ৪০ শতাংশ মানুষের কাছে দূষণমুক্ত জল রয়েছে, ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে উন্নত পানীয় জলের ব্যবস্থা রয়েছে এবং ২০% মানুষের কাছে বাড়িতে জলের যোগান রয়েছে। এই হিসাব থেকে ধরে নেওয়া যায়, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের কাছে নিরাপদ পানীয় জলের সংস্থান রয়েছে। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, আনুমানিক ৪৪০ কোটি মানুষের কাছে নিরাপদ পানীয় জলের সংস্থান নেই। বেশিরভাগ মানুষ যে জল পান করছে, তার মধ্যে রয়েছে কোলাই-এর মত ব্যাকটেরিয়া।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খরা ও বন্যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, সুপেয় জলের জন্য এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলে রিটার্ন আসে তিন বিলিয়ন ডলার। গ্রামীণ এলাকায় জলর জন্য বিনিয়োগ করলে আরও বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়। অন্যদিকে কৃষিকাজের জন্যও জল অপরিহার্য। সম্প্রতি এক রিপোর্টে জলে অন্যরকম বিপদ ধরা পড়ল সারা দেশ জুড়ে। সুইস ফেডেরাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাকোয়াটিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-র জল বিশেষজ্ঞ এস্থার গ্রিনউড জানান, এত মানুষের কাছে পানীয় জল নেই তা মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে এই পরিস্থিতির বদল দরকার। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ এই মুহূর্তে পরিশ্রুত পানীয় জল পাচ্ছেন না, প্রতিমুহূর্তে তাঁরা খাচ্ছেন বিপদজনক পানীয় জল। ২০১৫ সাল থেকে এই বিষয়ে একটি সমীক্ষা শুরু করেছিল ইউনাইটেড নেশনস। কুয়োর জল অথবা জলের পাইপ, বৃষ্টির জল সঠিকভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা দেখা হতো। তাতে দেখা গিয়েছিল, বিশ্বের জনসংখ্যার ৯০% মানুষ পানীয় জল পাচ্ছেন, কিন্তু তা নিরাপদ কতখানি তা নিয়ে তথ্য একেবারেই পাওয়া যায়নি।
বিগত ৪০ বছর ধরে প্রতি বছর জলের ব্যবহার বেড়েছে ১ শতাংশ হারে। বর্তমান আর্থ সামাজিক উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি থেকে অনুমান করা হচ্ছে আগামী ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই হারেই জলের ব্যবহার বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মধ্য আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু অঞ্চলে মরশুমভিত্তিক জল সমস্যা দেখা দেবে। বিশেষ করে যে সব অঞ্চলে জলস্তর এখনই প্রায় শূন্যে পৌঁছেছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলে– যেখানে এখনই জলাভাব দেখা দিয়েছে সেখানে অবস্থা আরও জটিল হবে।
রাষ্ট্রসংঘের বৈজ্ঞানিক, সামাজিক এবং শিক্ষামূলক সংস্থা ইউনেস্কো সম্প্রতি এক রিপোর্টে জানিয়েছে, বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলের মানুষ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ, তাঁরা বছরে প্রায় ১ মাস কঠিন জলাভাবে ভোগেন।এই রিপোর্ট অনুসারে, ২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে বিশ্বজুড়ে বন্যার হার বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। একইভাবে বেড়েছে খরাও। যার বেশিরভাগটাই মূলতঃ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে। এছাড়াও অপরিশ্রুত জলের কারণে ব্যাপকভাবে জলদূষণ ঘটছে। বিশ্বজুড়ে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে বর্জ্য জল শুদ্ধ করার কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই পরিবেশের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিছু কিছু দেশের ক্ষেত্রে এই হার ৯৯ শতাংশ। যার ফলে ক্রমশ বাড়ছে জলদূষণ।