তিন
দুজনে পরনের পোশাক মাথায় নিয়ে কোনরকমে কংসাবতী নদী পেরিয়ে এসে উঠলেন অন্য পাড়ে। প্রফুল্লর আর হাঁটার মতো দম এবং শক্তি দুটোই নেই। বিভূতিভূষণের গামছায় বাঁধা ছিল সামান্য কয়েকটি বাসি লুচি ও মিঠাই। কাতর আবেদন ও ক্ষুধার্ত হয়ে বসে পড়া প্রফুল্লর হাতে তিনটি লুচি ও একটি মিঠাই তুলে দিলেন বিভূতি। নিজে একখানি লুচি ও একটি মিঠাই খেলেন। তার পরেও প্রফুল্লর কাতর আবেদন চারটি পয়সার জন্য। পথে কিছু খাবার কিনবেন বলে। তখন কুয়াশা ভরা ভোরের অন্ধকার কেটে সকাল হয়ে উঠেছে। মাঠে মাঠে ভরে আছে সোনালি ফসল। বিভূতির চোখে মুখে অপার মুগ্ধতা। গতকালের কার্যক্রম থেকে আজ অবধি শুধুই হেঁটে চলেছেন ভারতমায়ের দুই অমৃত সন্তান।
নদীর পাড় ধরে দুজনে কোনও রকমে স্কুল বাজার অঞ্চলে এসে পড়েছে। তখন এদিকটা ছিল ফাঁকা ফাঁকা। প্রফুল্ল চার পয়সা পেয়ে দু’পয়সার ছয়টি মুলো এবং বাকি দু’পয়সার বুনো কুল কিনে নিলেন। দু’জনেই ভাগাভাগি করে খেয়ে রওনা হলেন ছাত্র ভান্ডারের দিকে। খানিকক্ষণ হাঁটার পরই মিলল তাঁদের বোর্ডিং। সেই দিনটি ছিল ৬ই ডিসেম্বর। ওইদিন মেদিনীপুরে ছিল কংগ্ৰেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন। দলের সভাপতি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরবিন্দ ঘোষ সহ এসেছেন একাধিক নেতৃত্ব। তাঁদের ঘিরে গোটা মেদিনীপুর জুড়ে সাজো সাজো রব। চারিদিকে সে কি উত্তেজনা এই সম্মেলনকে ঘিরে!
প্রফুল্ল আর বিভূতিভূষণ ছাত্র ভান্ডারে এসে পৌঁছাতেই ঘোর বিষ্ময়ে ক্ষুদিরাম একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে উঠলেন-“ওরে লাটতো মরে নাই, আমি যে দেখিলাম গাড়ি থামিয়া গেল।”ক্ষুদিরামের এই অবাক করা প্রশ্নে দুজনেই ঘোর বিষ্ময়ে পড়ে গেলেন। বিভূতি ও প্রফুল্লর ঘোর কাটেনি। ক্ষুদিরাম কি করে এই সব গোপন কথা জানতে পারলেন? এতটাই গোপনীয়তা ছিল এই অপারেশন, তা সত্ত্বেও এতো তাড়াতাড়ি খবর এলো কি করে? দুজনেই ভাবছেন, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। তাহলে ক্ষুদিরাম কি এই অপারেশনকে ধ্যানজ্ঞান করেছিলেন? অকুস্থলে সশরীরে না গিয়েও ক্ষুদিরাম যে ঘোর স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন সেই কথা তাঁদের জানালেন। তাঁদের অপারেশনে মন্ত্র দ্রষ্টার মতোই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। শারিরীক ভাবে না থাকলেও মনপ্রান সঁপে দিয়েছিলেন দুই প্রিয় মুক্তিযোদ্ধার পবিত্র কাজে। দু’জনেই অকপটে ক্ষুদিরামকে জানালেন অকুস্থলের আনুপূর্বিক ঘটনার কথা। তিন দিনের অমানুষিক শ্রম, খিদে তেষ্টায় বিধ্বস্ত তাঁরা।
(চলবে)