সোনার শহরের কথা উঠলেই চেখের সামনেই প্রথমেই ভেসে ওঠে ‘এল ডোরাডো’। যে শহরকে ঘিরে রয়েছে নানা উপাখ্যান আর নানা কল্পকাহিনী। শহরটির খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য অভিযাত্রী ছুটে বেড়িয়েছে। পাড়ি দিয়েছে দুঃসাহসী অভিযান। কিন্তু সেই স্বপ্নের শহরের দেখা কি পেয়েছিল, নাকি সবই ছিল মরীচিকা?বহুকাল আগে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় এক আদিবাসী গোষ্ঠী ছিল মুইসকা। তাদের ঐতিহ্য অনুসারে, নতুন রাজা নির্বাচন করার পর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সোনার গুঁড়ো মাখিয়ে তাকে গুয়াতাভিতার পবিত্র স্নান করানো হত।যাকে বলা হতো এল ডোরাডো। পরে এটি কীভাবে যেন হয়ে যায় এক হারিয়ে যাওয়া শহরের নাম, যেটি নাকি সম্পূর্ণটাই সোনা দিয়ে তৈরি। গুয়ানার লেক পারিমের কাছে কল্পনার শহরটির ঠিকানা।

এল ডোরাডো এক মিথ নগরী, যা সোনা দিয়ে তৈরি বলে স্প্যানিশদের মতো অনেকের ধারনা ছিল। আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ডোরাডোর কথা বিভিন্নভাবে ছড়াতে শুরু করে। ষোড়শ শতকে এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো হুয়ান রড্রিগজ ফ্রেইলের লেখা ‘দ্য কনকোয়েস্ট অ্যান্ড ডিসকভারি অব দ্য নিউ কিংডম অব গ্রানাডা’।ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের কাছে বাকি পৃথিবীর অনেকটাই অজানা ছিল। গুজবের সঙ্গে কল্পনা মিশে তাদের ধারণা দৃঢ় হয়, কোথাও নিশ্চয়ই সোনায় মোড়া এই শহরটি ঠিক আছে। বহু গল্প, উপন্যাস আর সিনেমায় এই এল ডোরাডোর নাম উঠে এসেছে। যার মধ্যে একটি কবিতা স্বয়ং এডগার অ্যালান পোর লেখা। তিনি বলেছিলেন, “এল ডোরাডো যেতে চাও, তবে চাঁদের পাহাড় পেরিয়ে, ছায়ার উপত্যকা ছাড়িয়ে, হেঁটে যাও, শুধু হেঁটে যাও…”

ফ্রান্সিসকো পিসারো ১৫৩০ সালে ইনকা সাম্রাজ্য লুট করার পর বাইরের পৃথিবীর সবাই ভাবতো, লাতিন আমেরিকার যে জায়গাগুলো এখনও বাইরের মানুষের কাছে অনাবিষ্কৃত, সেখানে কোথাও বিশাল ধন সম্পদের সাম্রাজ্য রয়েছে। এরাই এই সোনার রাজ্যের গুজব তৈরি করে।একই সময়ে অভিযাত্রী কুয়েসাদা গুয়াটাভিটা হ্রদের জল সেচে চার হাজার সোনার টুকরো পেয়েছিলেন। ধারণা প্রতি বছর উৎসবের সময় আদিবাসীরা হ্রদে প্রথানুযায়ী সোনা ছুড়ে ফেলতো। কিন্তু অনেকেই তা বিশ্বাস করেন না। সোনার লোভে নানা জায়গা থেকে লোকেরা এসে প্রচুর পরিশ্রম করে হ্রদের গভীরে অনুসন্ধান চালিয়েছে।কেউ কেউ সোনার টুকরো সংগ্রহ করতে পারলেও সোনার শহর ‘এল ডোরাডো’র খোঁজ পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।

স্প্যানিশরা লাতিন আমেরিকা জয় করে স্থানীয় মুইসকা গোষ্ঠীকে খুঁজে বের করে লেক গুয়াতাভিতায় খোঁজ চালিয়ে কিছু সোনা পেয়েছিল। কিন্তু তাতে তাদের আঁশ মেটেনি। ১৭৯৯-১৮০৪ সালে অভিযান চালিয়ে আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট লাতিন আমেরিকায় এক দুঃসাহসিক অভিযান করেন। তীব্র খরস্রোতা ওরিনিকো নদী পাড়ি দেন তিনি। দুর্গম অঞ্চলে তাঁবু খাটিয়ে থাকেন। ১৮০১ সালে ৪৫ দিন দুর্গম পথ অতিক্রম করে পৌঁছতে সক্ষম হন রিও ম্যাগদালেনাতে।যে জায়গার খোঁজে বহু অভিযাত্রী দীর্ঘকাল ধরে হন্যে হয়ে ঘুরছিল। কিন্তু সেই সোনা খুঁজে পেতে তিনিও ব্যর্থ হন। পরে তিনি শহরটির অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করেন।

তবে এল ডোরাডো অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি। ১৫৪১ সালে সোনার শহরের খোঁজে অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো দে ওরেয়ানা আর গনসারো পিসারো অভিযানে বেরিয়েছিলেন। আমাজন নদীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে ওরেয়ানার পুরো দৈর্ঘ্যটাই জানা হয়ে যায়।গহীন বনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা আমাজন নদী যে কত বড়, তা কেউ কখনও আন্দাজও করতে পারেনি। যদিও সোনার শহরের খোঁজ মেলেনি, তবু এই আবিষ্কারের জন্যই ইতিহাসের পাতায় উঠে যায় ওরেয়ানার নাম। এরপর ২০০১ সালে রোমের এক পাঠাগারে হঠাৎ এক ধুলোমাখা নথি আবিষ্কৃত হয়। তাতে এল ডোরাডো শহরের কথা লেখা রয়েছে। আন্দ্রিয়া লোপেজ নামের এক ধর্মযাজক ১৭ শতকের সেই নথি লিপিবদ্ধ করেছেন বলে জানা যায়। লিপি থেকে জানা যায়, সেই শহরের ধনসম্পত্তির কথা। কিন্তু শহরটি কোথায় তা খোলাসা করেননি যাজক। শুধু বলেছেন পেরু থেকে ১০ দিনের হাঁটাপথ। কিন্তু পেরুর কোন শহর থেকে বা কোন দিক থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে তার কোনো সঠিক তথ্য লিপিতে জানা যায়নি।

এল ডোরাডোর সন্ধান পেতে গত ১০০ বছরে নানা দেশের সংগঠিত অভিযানই হয়েছে অন্তত ১৪টি। এই অভিযানে ইনকা সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেলেও দেখা মেলেনি সেই স্বর্ণ শহরের। আবার অনেক সময়েই হারিয়ে গেছেন অনেক অভিযাত্রী। তবে, এই কিংবদন্তি যে পুরোপুরি মিথ্যা, সেটাও বলা যাবে না। কিছু ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি নির্দেশ করে ইনকান এক আদিবাসীকে, যারা আধুনিক কলম্বিয়ার গুয়াতাভিটা হ্রদের কাছে বাস করত। তাদের সমাজের এমন এক রীতি চালু ছিল, যেখানে তাদের নেতারা হ্রদে গহনা, স্বর্ণ এবং ধনসম্পদ ফেলে দিতেন। কিংবদন্তির বদৌলতে সেই হ্রদ এখন পরিণত হয়েছে পর্যটকদের আখড়ায়। তবে, সেখানে কোনো ধনভাণ্ডার পাওয়ার আশায় গেলে অবশ্যই খালি হাতে ফিরে আসতে হবে।