ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলার ছিলেন জ্যাক দ্য রিপার। ১৮৮৮ সাল থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত পূর্ব-লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলের আশপাশে সর্বমোট এগারোটি খুন করে তোলপাড় ফেলেছিল এই কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার। সিরিয়াল কিলাররা যে কেবল ভয়ংকর খুনের জন্যই বিখ্যাত হয়েছেন তা কিন্তু নয়। টেড বান্ডি নামে এক সিরিয়াল কিলারের প্রেমে পড়েছিলেন বহু নারী। তবে পুরুষরাই নন সিরিয়াল কিলারের তালিকায় আছেন অসংখ্য নারী। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন এলিজাবেথ বাথরি। তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী সিরিয়াল কিলার। যিনি খুনের ঘটনায় নৃসংশতার চরমে পৌঁছেছিলেন। তিনি রক্ষক হয়েও ভক্ষকের ভূমিকাই বেশি পালন করেছিলেন। কারণ, তিনি ছিলেন হাঙ্গেরির রানি, সৌন্দর্য ধরে রাখতে হয়েছিলেন সিরিয়াল কিলার।
নারীরা নিজেদের সৌন্দর্যের ব্যাপারে বেশিই সচেতন। নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখতে কতো কিছুই না করেন। এলিজাবেথ বাথরি নিজের রূপ-যৌবন ধরে রাখতে প্রায় ৬০০ কুমারী নারীর রক্ত পান করেছিলেন। কেবল রক্ত পান নয়, সেই রক্তে স্নান করতেন এমনকি তাদের মাংসও খেতেন। রানি ছিলেন যেমন বদমেজাজি, তেমনি হিংস্র আর অত্যাচারী। তার বিশ্বাস ছিল, কুমারী মেয়েদের রক্ত তাকে চিরযৌবনা রাখবে, তাই একের পর এক কুমারীকে হত্যা করতেন তিনি। ইতিহাসে তিনি ব্লাড কাউন্টেস বা কাউন্টেস ড্রাকুলা নামেও পরিচিত। হাঙ্গেরির ট্রান্সিলভেনিয়ায় এক অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া এলিজাবেথ বাথরি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন খিটখিটে আর বদমেজাজি। হয়ত শিশু বয়স থেকে ভয়ানক সব অত্যাচারের দৃশ্য দেখে বড় হওয়ার কারণে তার মেজাজ এমন হয়ে উঠেছিল। একবার তিনি দেখেন একটি জীবন্ত ঘোড়ার পেট কেটে তার মধ্যে অপরাধীকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ঘোড়ার পেট সেলাই করে দেয় প্রহরীরা। এই ঘটনা তার মনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তার হিংস্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
তাই ছোট থেকেই অত্যাচারী মনোভাব হওয়ায় অন্যের মৃত্যু যন্ত্রণা দেখে তিনি তৃপ্ত হতেন। খুব অল্পতেই তিনি রেগে যেতেন। খিঁচুনি আর মাইগ্রেনের সমস্যা থেকে তিনি এমন হয়েছেন বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ। আবার অনেক ইতিহাসবিদ লিখেছেন, তার পরিবারের অপরাধীরকে এমন কঠিন সব শাস্তি দেওয়ার ধরন তার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। অভিজাত বংশের মেয়ে হওয়ায় তার বিয়েও হয়েছিল সম্ভ্রান্ত পরিবারেই। তবে বিয়ের আগেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে মা হন এলিজাবেথ। এরপর ১৫ বছর বয়সে ফেরেন্স নাডাসডি নামে এক উচ্চবংশীয় লোকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ফেরেন্স ছিলেন হাঙ্গেরি রাজ্যের সেনাপতি। কথিত, ফেরেন্স তার স্ত্রী এলিজাবেথের মতোই অত্যাচারী ছিলেন। অটোম্যান বন্দিদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাতেন তিনি। নিজের দাসদের দু’পায়ের গোড়ালির মাঝে কাগজ রেখে আগুন ধরিয়ে দিতেন। এছাড়াও অটোম্যানদের যুদ্ধে তার হিংস্রতা আর অমানবিকতার কারণে তাকে ডাকা হত ব্ল্যাক হিরো অব হাঙ্গেরি। বিয়ের কিছুদিন পরই ফেরেন্স যুদ্ধে চলে যান। আর সেখান থেকে এলিজাবেথকে তিনি অত্যাচারের নতুন নতুন পন্থার কথা জানাতেন।
কুমারী মেয়েদের রক্ত পান, স্নান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন সবসময়। এছাড়াও তার কয়েকজন বিশ্বস্ত দাস ছিল। যারা এলিজাবেথের সব অপকর্মের সাক্ষী। এলিজাবেথ কুমারী মেয়েদের ছোট্ট খাঁচায় বন্দি করতেন। এরপর তাদের সিলিংয়ে ঝুলিয়ে রেখে শরীরে বরফ জল দিতেন যাতে তারা ঠান্ডায় জমে মারা যায়। বিকারগ্রস্ত রানি এলিজাবেথ দাস দাসিদের হাতের তালুতে গরম লোহা রেখে তাদের যন্ত্রণায় পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করত। সাঁড়াশি দিয়ে দাসদের আঙ্গুল টেনে ছিঁড়ে ফেলত। একবার এলিজাবেথ দাসীর শরীর থেকে মাংস কেটে তাকে দিয়ে রান্না করিয়ে তাকেই খেতে বাধ্য করেছিল। এছাড়াও মেয়েদের শরীরে মধু লাগিয়ে সারাদিন বাইরে রেখে দিত। যাতে মৌমাছি এবং অন্যান্য পোকামাকড় তাদের খেয়ে ফেলতে পারে।
স্বামী ফেরেন্সের মৃত্যুর পর এলিজাবেথ আরও বেশি নৃশংস হয়ে ওঠে। সে মেয়েদের নখে, ঠোঁটে, গালের নিচে সূচ ফুটিয়ে রাখত, শরীর থেকে মাংস কেটে নিত। অনেক পুরুষের জীবনও নিয়েছিল। বিয়ের আগে এবং তার স্বামীর মৃত্যুর পর অসংখ্য পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিছুদিন পর নতুন একজনকে পেলে আগের জনকে মেরে ফেলতেন। এছাড়াও এলিজাবেথের সম্পর্কে আরও একটি তথ্য জানা যায়, তিনি উভকামী ছিলেন। যদিও তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি যে ৬০০-রও বেশি খুন করেছিলেন সেই তথ্য পাওয়া যায় এলিজাবেথের নিজের লেখা ডায়েরি থেকেই। তার একজন সহযোগীই তার ডায়রি আদালতে উপস্থাপন করেন। সেই সময় রাজ্যের গরিব পরিবারের মেয়েদের কাজের লোভ দেখিয়ে এলিজাবেথের কাছে নিয়ে আসা হত আর অসহায় মেয়েরা শিকার হত এলিজাবেথের বিকারগ্রস্থ স্বভাবের নির্মম শাস্তির। একের পর এক মেয়েরা নিখোঁজ হতে থাকলে সেই সব পরিবার আর তাদের মেয়েদের সেখানে পাঠাতে চাইতেন না। এরপর মধ্যবিত্ত পরিবার এমনকি অভিজাত পরিবারের মেয়েদেরকে ভালোভাবে লালন পালনের প্রতিশ্রুতিতে আনা হত।
কিন্তু একদিন এই কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের দিন শেষ হয়। সেদিন তার সহযোগীর তিনজনকে ফাঁসি এবং চতুর্থ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এলিজাবেথকে বন্দি রাখা হয় জানালাবিহীন ছোট এক ঘরে। সেখানেই ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, মানসিক সমস্যা থেকেই এলিজাবেথ এমন নৃশংস হয়ে উঠেছিলেন। এলিজাবেথের পরিবারে অনেকেই ছিল খুনি ও খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির। হয়ত বংশগতভাবেই এই স্বভাব পেয়েছিলেন এলিজাবেথ।