এই তো সেদিন সকালে জলখাবার খেয়ে কাগজে চোখ চালাচ্ছিলাম। এখন কাগজ পড়িনা উল্টেও দেখতে উৎসাহ নেই। ব্যাপারটা যেন ক্ষণিকের অতিথি। বেলা বাড়লে বাসী হয়ে যায়। এই মিনিটে মিনিটে ব্রেকিং নিউজ-এর হুটোপুটিতে কয়েক দশকে মোটামুটি আমরা অভ্যস্ত করে নিয়েছি। কেচ্ছা-কোন্দল গ্যাসের দাম পেট্রোলের দাম এসব জানানোর সাফল্য ইলেকট্রনিক মিডিয়া ইন্টারনেট বেশ উদার হয়ে আরও বেশি ব্যস্ততায় বুঝিয়ে ছাড়ছে মগজে ভরে দিচ্ছে। তরুণদের বেকারত্ব নিয়ে কী কী আলোচনা ও সভাসমিতি হলো বা নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব কিভাবে বর্তাচ্ছে তৎসম্পর্কিত ঘোষণা আমার জরুরি লাগছে না বা নাসায় তরুণ বিজ্ঞানী কলকাতা ফিরে কী বলবেন এতেও উৎসাহ নেই। স্বাস্থ্য উদ্ধারের নানা টিপস ফিরেও দেখতে চাইনা বরং রক্ত ও বায়ু মাপার কিছু যন্ত্র থাকলে আমি আশ্বাস পেতাম। আমার জীর্ণ অন্দরের সংস্কার হত। তা সে যাই হোক আমি সেদিন চেয়ারে হেলান দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে (চোখ ও চশমায় বর্তমানে যে সেটেলমেন্ট তার হিসেবে) কাগজের পাতা উল্টে এপাশ ওপাশ পড়েছি কিছুটা, বাকিটা চোখ বোলানোও হচ্ছিল।
এই তো কিছুদিন আগে শেষ ফেব্রুয়ারিতে বসন্ত ঢুকেছে তবু ঘরের জানালা আঁটা। একটা বই খুলে বসে আছি ওদিকে পাশের বাড়ি থেকে সন্ধের বাতাসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কোরাসে গান ভেসে আসছে। কানে এল, এ মণিহার আমার নাহি সাজে। আমার জানাশোনা হলো ওই পরিবারে গানবাজনা হয় এবং মান নিতান্তই খারাপ নয় এবং মাঝেমধ্যেই আমাকে ওদের গান শুনতে হবে। সে খুব দুঃখের হবেনা, এখন এই রেয়ার এপিসোড টিভির বদলে স্বয়ং কেউ বা কারা মাদুর বা শত্রঞ্চি বিছিয়ে আয়োজন করছে ভেবে। নিদেন মফঃস্বলের পাড়ার সিমেন্ট বাঁধানো পিচ্ছিল গলিতেও কান পাতলে শোনা যায়না। চাহিদার উপকরণ মোড়ক বদলেছে সে লোম জড়ানো উলঙ্গ মানুষের কাল থেকেই। বদলি দিনের বন্দোবস্ত এখন তো নিতান্তই কম নয়।
ওই তো… হচ্ছে, পৃথিবী আমারে চায় রেখোনা বেঁধে আমায়…। আমি জেগে বসে এক দিগন্ত খুঁজে পেয়েছি। বেশ টেরটি পাচ্ছি সন্ধেটুকু ফুরফুরে হয়ে আমার বদ্ধ ঘরে কিছুটা ঢুকেছে। ইদানিং অহেতুক ফোন করি বন্ধুবান্ধব পরিচিতদের সঙ্গে, খেজুরে সময় কিছুটা কেটেও যায়। বিকেলটা এদিক ওদিক ঘুরে আমি বাজারদরকে তোয়াক্কা করতে করতে অসুখী হয়ে উঠছিলাম। নিজের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় সে তো হবার জো নেই। বই বদল করি বা বাইরের উঠোনে গন্ধরাজ ফুলের গাছটার সামনে কিয়ৎ সময় দাঁড়াই। এসে অ্যানড্রয়েডে আঙ্গুল ঘষি, কতকিছু যে ভিড় জমায়! নানা অঘটনের মাঝে কায়ক্লেশে আমিও ছন্দ খুঁজতে বেরোই। সবই তছনছ করে করে দেখি।
বিকেলে একবার চা বানিয়ে খেয়েছি। বেরিয়ে ভাবি লম্বা হাঁটা যাক কিন্তু ওই সঞ্জয়ের দোকানেই একটা প্লাস্টিকের টুল নিয়ে বসে পড়ি। প্রসঙ্গ খুঁজি অপ্রসঙ্গ এসে পড়ে। মলয়ের দোকান থেকে চা আসে একটা স্টিলের গ্লাসে ভাগাভাগি করে কাগজের কাপে ক’জন চুমুক দিই। কথা থাকেনা যা থাকে অল্পসময়েই শেষ হয়ে যায়। বুঝি আমার নির্বাসনের সামনে কোনো সেতু নেই আবার কোনো আঠালো কথার ফাঁদে ঢুকে পড়ি। গন্ধ হারিয়ে যায় যেটুকু জমেছিল এ বোধহয় পবিত্রতা হারানোর মতো কী এক পুরনো ভয়। পবিত্রতা কি এসব গম্ভীর প্রশ্ন আমার জানা নেই। শুধু একটু ফিকে ধারণার মতো যা আছে তা আবার ম্যাচ করেনা ইউনিভার্সাল কোডে। শুধু বুঝি এটা মৃত্যু পর্যন্ত থেকে যায় নাছোড়বান্দা আর নিষ্ঠুর উপস্থিতি নিয়ে। এদিকে সঞ্জয়ের স্মার্টফোনের স্ক্রিনে চ্যানেল ওপর নিচ করে অনেক খবরের ক্যাওস ঢেলে দিচ্ছে।
ফিরে এসে হাত মুখ ধুয়ে পাজামার দড়িতে ফাঁস দিতে গিয়ে দ্রোহ ঘোষণা করি বিড় বিড় করে। এই দেশ, মানচিত্রে আমার দেখা ভারত আমাকে এরকম চেহারা দিয়েছে। বেশিরভাগ ফ্রি-সাইজ ফুল স্লিভ আমার ঢোলা হয়। তবু আমি ওটুকুই মেনটেন করে যাচ্ছি ওদের কর্মসূচী আর আমার অলিখিত প্রতিশ্রুতি মতো। ভোট আসছে যা আগেও নিয়মমতো এসেছে। মহামহিম কমিশন নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেছে ওদের হলঘরে যে যার বরাদ্দ চেয়ারে বসে। কোটি কোটি হয়তো অগুনতি মানুষ ভোট দেবে এই মচ্ছবে শেষে গোনা হলে সেটা হবে অতি সতর্কতায়। একটি ভোট একটি প্রাণ। অমূল্য । নষ্ট হওয়া চলবে না হলে তাকে চোকানো যাবেনা। আগেই যেটুকু লুঠপাট হবে সেকথা অন্য তা এখানে বলার দরকার নেই। আমার মতো কত উলুখাগড়া আমরা লাইনে দাঁড়াবো। ভোট দেবো। কয়েকদল শিকারী আমাকে গেঁথে নেবে।
আমি খুব সকাল সকাল রোদ বাড়ার আগেই বুথে লাইন দেবো। হাসি ইয়ার্কি শুনবো কিন্তু সাবধানী হয়ে রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়ে ঘণ্টাখানেক লাইনে থাকবো। এই কর্তব্যে আমি বেশি হেরফের করিনি সাম্প্রতিক অতীতেও। আমি তখন বন্ধু না স্বামী না দাদা না বাবা না সন্তান না। আমার ভেতরে তখন অবিচল ভোটগামী এক নিষ্ঠ নাগরিক এক বা একাধিক অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আকচা আকচি করছে। তিল তিল করে শেষপর্যন্ত আমার একটাই ভোট আমি গত কয়েকবছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছি। পাড়ার দলের ক্লাবের ছেলে ছোকরারা নজরে রেখেছে গুনতিতে রেখেছে। এসময়টা আমার দামও ভালো থাকে। সব দল ভাবে আমি ওদের একনিষ্ঠ অনুসারী। ওদের ম্যানিফেস্টোই আমার ম্যানিফেস্টো।
বেশ কয়েক বছর ধরে একটা স্বচ্ছল মায়া আমাকে ঘিরে রাখে যতই বাজারদরের ওঠানামা হোক না কেন আমাকে ডুবিয়েও ভাসিয়ে রাখে। তবু আমি নিষ্ঠার সঙ্গে নির্বাচন বিষয়ে খোঁজ নিই, ফোড়ন কাটি, চুটকি ছুঁড়ে দিই এপাশ ওপাশ খেয়াল রেখে। নিজস্ব বাকস্বাধীনতা নিয়ে নিজের স্বপক্ষে ওকালতি করি। এসব টুকটাক আর কী! সেদিন হিসেব করে দেখলাম আমি মাস্টারদা অরবিন্দ বাঘাযতীন ক্ষুদিরাম উল্লাসকরের পর অনেকক’টা প্রজন্ম ডিঙিয়ে প্রায় লাফ মেরে কাদায় এসে পড়েছি। আমার সামনে এখন বীরভূম কোচবিহার নদীয়া চব্বিশ পরগনা এগুলোই মডেল। ব্যক্তি নয় দেশ বড়ো। সামনে পড়ে আছে জেলা ব্লক পঞ্চায়েত বুথ সংগঠন এসবের দখলদারি মজবুত করার প্রেরণা। ওরাই আমার ভোট নিয়ে নেবে।
আমার সাঁতার শেষ হয়ে গেছে প্লবতা নেই। কঠিন জমাট শিলার ওপর আমি উপুড় হয়ে পড়ে আছি। অনেকেই লক্ষ রাখছে একটা মধুর দিনের অপেক্ষায় এক আলসেমি, কিছুটা সান্ত্বনার মধ্যে অজগর বৃত্তি নিয়ে দিব্যি আছি। পাশের ফোকলা চোয়ালহীন মানুষেরা আমাকে গল্প শোনাচ্ছে। আবার দু’টো চা অর্ডার দিলাম। লিকার-চিনি ছাড়া। এখনও যদিও রক্তে শর্করা বাড়েনি। অন্যান্য সহ্যশক্তি ঠিকঠাক থাকলেও ইন্টেসটাইন পাচন রসে সিক্ত নয়, হজম শক্তি গেছে। মনে রেখেছি এখন পর্যন্ত অঘাটে অনেক জল খেয়েছি। ফোতো বাবু, বচনবাগীশ, রায়বাঘিনী স্ত্রী লোক… তাদের সঙ্গে সেসব কতো বিস্তীর্ণ ঘোরাঘুরি! এখনও শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছি ছাড়ছি- এটুকু আপাতত আশ্বাস পাচ্ছি, ভেতর জানান দিচ্ছে। এটা আবার দেখা যায়না ভেতরেই লুকিয়ে মেশিন চলছে। যা কিছু চুরমার হচ্ছে তাও খুব গোপনে, অন্দরে। খুঁচিয়ে না তোলাই ভালো।