সিনেমার পোস্টার কী আমাদের কাছে খুব একটা মর্যাদা পায়? খুব কম লোকেই একটা সিনেমার পোস্টারকে মন দিয়ে দেখে বা ভাবে।আগে প্রেক্ষাগৃহে ছবি মুক্তির আগে দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার লটকে যেত। নানা মাপের রঙিন অথবা সাদা কালো পোস্টারগুলি আমাদের দুটি বার্তা জানিয়ে দিত- কোথায় কোথায় আর কখন কখন। ব্যাস এই পর্যন্তই। তারপর চার-পাঁচ বেলা গড়াতেই ঝড় জল ও হাওয়ায় সেই পোস্টারগুলি আর খুঁজে পাওয়া যেত না।কোথাও কোনও দেওয়ালে আবার ছবি মিলিয়ে যাওয়ার পরেও পোস্টারটি বেঁচে থাকতো। কিন্তু তাতেই বা কি?
একটি ছবি দেখার আগে ছবিটির বিষয় সম্পর্কে দর্শক মনে ধারণা তৈরি করে দেয় ছবিটির পোস্টার। সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম ছবির পোস্টার তৈরির সময়ও ঠিক এই কথাগুলি ভেবেছিলেন। হয়ত তিনি মেসেজ ও মিশন বা বার্তা ও লক্ষ্যকে অনেক স্পষ্ট করতে সিনেমা পোস্টার নিয়ে অনেক বেশি ভেবেছিলেন। সেকারণে বিদেশের ও স্বদেশের জন্য করা পোস্টার হত আলাদা। এবার সরাসরি দেখবো তিনি তাঁর ছবির একটি পোস্টারে রং-রেখা-অক্ষরকে কীভাবে বিষয় অনুযায়ী সাজানোর চেষ্টা করেছেন। পোস্টারের রং-রেখা আর অক্ষরের বিন্যাস কোথায় কিভাবে ছবির বিষয় ভাবনার সঙ্গে মিলে আমাদের ভাবনায় ফুটে উঠেছে।
আর পাঁচটা সিনেমা পোস্টারের থেকে সত্যজিৎ রায়ের ছবির পোস্টারের ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফি বা লেখাঙ্কন যে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা সহজেই নজরে আসে। হতে পারে ‘পথের পাঁচালি’ তৈরির আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন পেশাদার ডিজাইনার, ক্যালিগ্রাফিতে তাঁর বিশেষ দখল ছিল। এছাড়া লেখাঙ্কনের মধ্যে বিচিত্র হরফের মধ্যে যে গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়কে প্রকাশ করা যায় তা তিনি জানতেন। অলঙ্কৃত হরফের মধ্যে নানা ধরণের মোটিফ বা লাইন ব্যবহার করেও যে ছোটখাট বিষয়কে নজরে আনা যায় সেটাও তিনি ভাল জানতেন। বইয়ের প্রচ্ছদেও তিনি সেই ধাঁচ যেমন সার্থকভাবে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর নিজের ছবির নামাঙ্কনেও সেই অসাধারণত্ব ফুটে উঠেছে বারবার।
‘পথের পাঁচালি ছবির পোস্টারে শব্দ দুটির রেখাঙ্কন যদি সেভাবে খেয়াল করা যায়, সেখানেও আমাদের গ্রাম্য সমাজ-সামাজিকতার স্পন্দন ফুটে ওঠে। পরের ছবি অপরাজিত-র পোস্টারের নামাঙ্কন খেয়াল করলে দেখা যায় ‘অ’বর্ণটি অন্যগুলির থেকে তুলনায় বেশ বড় করে তিনি অপরাজিত-র ব্যঞ্জনা এঁকেছিলেন। অপুর সংসার কথাটির ক্যালিগ্রাফিতেও আলপনার ধাঁচ, দেবী ছবির পোস্টারে দেবী শব্দটির রেখাঙ্কনে নাটমন্দিরের ঋজু স্তম্ভ লক্ষ্য করা যায়, যেমন চারুলতা-র রেখাঙ্কনে সেলাই বা এমব্রয়ডারির রেখা ফুটে ওঠে। কাঞ্চনজঙ্ঘা-র রেখঙ্কনেও ফুটে উঠেছে পর্বত। অন্যদিকে মহানগর বলতে যে সার দেওয়া বহুতল বাড়ির ছবি মনে ভেসে ওঠে সত্যজিৎ রেখাঙ্কনেও সেই ভাবনাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্যজিৎ তাঁর একমাত্র হিন্দি ছবি শতরঞ্জ কি খিলাড়ি-র নামাঙ্কন করেন ইংরাজিতে তবে তার মধ্যে ছিল উর্দু লিপির মেজাজ। সত্যজিৎ প্রতিটি ইংরাজি হরফের নীচের অংশে দাবার ঘুঁটির আকারগত ছাঁচ এনেছিলেন দাবাকে স্পষ্ট করতে। এই ভাবে লেখাঙ্কনের মধ্যে হরফকে নানা ভাবে সাজিয়ে, অলঙ্কৃত করে তিনি দৃশ্যরূপকে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
সত্যজিতের হরফ ব্যবহার, হরফগুলিকে প্রয়োজন অনুযায়ী অলংকরন করা, হরফে বিভিন্ন মোটিফ যোগ করা- এসবই এসেছে বিষয়বস্তুর হাত ধরে। তাঁর হরফের আশ্চর্য ব্যবহারে মধ্যে ফুটে উঠেছে এসেছে সময়ের কথা। যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী-তে যে রক্তের ফোটার মতো লাল রঙের ব্যবহার সেতো গত শতাব্দীর সত্তর দশকের কলকাতার রক্তঝরা দিনের কথা বোঝাতেই। হরফের আকার প্রকারকে তিনি তার ছবির পোস্টারে প্রায় সব সময়েই যথাসম্ভব অভিনবত্বে অর্থবহ করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। সেই বুদ্ধিমেধার প্রতিফলন দেখা যায় চিড়িয়াখানা ছবির বিজ্ঞাপনে যখন ‘খুন’ শব্দটির হ্রস-উ-কার রক্তের দাগের মতো নীচে নেমে আসে। পরপর কয়েকটি গাছের প্রতিরূপ হিসেবে ফুটিয়ে তুলতেই সত্যজিৎ অরণ্যের দিনরাত্রি কথা দুটির প্রতিটি উলম্ব রেখাতে বৃক্ষের আভাষে আঁকেন। নায়ক কথাটির অন্তস্তিয়-র ফুটকিতে তারা বা জয়বাবা ফেলুনাথ-এর লয়ের নীচে হ্রস-উ-কারে রিভালবার এঁকে তিনি দর্শকদের ছবির আখ্যান ধরণকে আগেভাগেই জানান দিয়ে দেন। একইভাবে সোনার কেল্লা কথা দুটির সঙ্গে কাঁকড়া, শাখা প্রশাখা-র পাশে হৃদস্পন্দনের তরঙ্গ রেখা যে কতখানি অর্থবহ তা ছবিটির দর্শকমাত্র বুঝতে পেরেছেন।
সিনেমা পোস্টারে ছবির নামে এই মানের ক্যালিগ্রাফি বা লেখাঙ্কন তাঁর চলচিত্রের মতোই শিল্পকলাগুণময়। তাঁর অন্য সব কীর্তির মতো ছবির পোস্টারকেও তিনি নিখুঁত এবং শিল্পসুষমামণ্ডিত করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর অন্য সব নির্মানের মতোই তাঁর ছবির একেকটি পোস্টারের মধ্যেও রেখে গিয়েছেন দক্ষতা, মুন্সিয়ানা ও মননশীলতা।