তারিখ- ১৯১৬ খ্রি:র ৫ই অক্টোবর, স্থান- সানফ্রান্সিসকো প্রদেশের একটি হোটেল
ইউরোপ ভ্রমনের সময় আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো প্রদেশের একটি হোটেলে উঠেছেন কবিগুরু। আন্তর্জাতিকতা ও মানবতাবাদী হিসেবে তিনি তাঁর মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। হোটেলে নিজের ঘরে বসে “দ্য পোর্টল্যান্ড” নামে সেখানকার একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। হোটেলের নিরাপত্তারক্ষী ও কবিগুরুর জন্য নিযুক্ত বিশেষ মার্কিন আরক্ষা বাহিনী হামলাকারীদের কঠোরভাবে প্রতিহত করে। তিনি কোনও ক্রমে প্রানে বেঁচে যান। ভয়ঙ্কর আক্রমনের খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা বিশ্ব জুড়ে নিন্দা, ধিক্কার, ঘৃনা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব জুড়ে। বিশ্বের আপামর রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়।
এই জঘন্য হামলা ও চক্রান্তকে কুৎসিত ভাবে ব্রিটিশ সরকার বিভ্রান্তির রঙ চড়িয়ে দেয়। তাদের বক্তব্য ছিল- রবীন্দ্রনাথ কে হত্যা করতে চেয়েছিল গদর পার্টি। প্রসঙ্গত, ১৯১৩ সালে সান ফ্রান্সিসকো শহরের হিলটপে গদর পার্টি গড়ে উঠেছিল। গদর পার্টি বলতে মূলত বোঝায় বিপ্লবী সংগঠন। এই সংগঠনের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম এবং শিখ ধর্মাবলম্বীরা ছিলেন, যাদের উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। ১৯১৫ সাল থেকে ব্রিটিশদের দ্বারা এই গদর পার্টি নানাভাবে অত্যাচারিত হতে থাকে। যাই হোক সীমান্ত গান্ধী ব্রিটিশ সরকারের এই হীন ও কুৎসিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। বিশ্বকবিও দ্ব্যার্থহীন ভাষায় মন্তব্য করলেন- “গদর পার্টি একটি বিপ্লবী দল, তারা কখনোই এরকম হীন কাজ করতে পারে না”। সুচতুর ইংরেজ সরকার ভারতের হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে বলে কবির একান্ত অভিমত।
গুরুদেব দেশে ফিরে “বিচিত্রা” পত্রিকায় (১৩৩৪, শ্রাবন সংখ্যা) একটি জ্বালাময়ী প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর উপর আক্রমণ করার ঘটনাটিকে বিকৃত রূপ দেওয়ায় আমেরিকার সংবাদপত্রগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। আমাদের দেশেও এই হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের উপর অনুরাগ থাকলেও বিশ্বকবি কোনোও দিন স্তাবকতা করে একলাইনও লেখেন নি।
১৯১৩-তে নোবেল পাওয়ার পর তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগণে। সেই বছর আমেরিকা যাওয়ার পরে প্রতিটি শহরে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতায় মুগ্ধ সবাই। লস অ্যাঞ্জেলসের এক পত্রিকা যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে তাঁর রূপের তুলনা করে। আমেরিকায় তাঁর বইয়ের বিক্রি নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে সেই সময়। এত কিছুর পরেও তাঁকে খুনের চেষ্টা! যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁকে খুনের চেষ্টার এই অভিযোগ বিশ্বাস করতেন না। এই মর্মে স্থানীয় খবরের কাগজে লিখিত ভাবে জানিয়েও ছিলেন যে গোয়েন্দাদের সন্দেহের ভিত্তিতে তিনি কোনও অনুষ্ঠান বাতিল করছেন না। তাঁকে খুনের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ ভরসা রাখেন দেশের মানুষের উপর। তাই পুলিশের সাহায্য ছাড়াই সমস্ত সভায় অংশ নেবেন। খাতায় কলমে ব্যাপারটা এটুকুতে মিটে গেলেও এর শিকড় ছিল অনেক দূর।
প্রথমবার আমেরিকা সফরের সময় হরদয়ালের (গদর-এর সম্পাদক )সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়নি, যদিও কবি তাঁকে চিনতেন। তবে দেখা যাঁর সঙ্গে হয়েছিল, তিনি হলেন বসন্ত কুমার রায়। পাঠকের নিশ্চয়ই জানা আছে যে এই বসন্ত কুমারই হলেন ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রথম রবি-জীবনীর লেখক। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (১৮৮৭-১৯৫৫) স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, বসন্ত কুমার যদিও বিপ্লবী ছিলেন না, কিন্তু অন্যান্য ভারতীয় বিপ্লবী যেমন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮০-১৯৬১) এবং তারকনাথ দাসের (১৮৮৪-১৯৫৮) সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। অন্য যে আরেকজন আমেরিকা-প্রবাসী মেধাবী সাহিত্যিকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগের কথা সকলের জানা, তিনি হলেন বহু গ্রন্থের লেখক ধন গোপাল মুখোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৩৬), যিনি নিজে ছিলেন বিপ্লবী এবং যাঁর সঙ্গে বিপ্লবীদের সবার পরিচয় ছিল।
1 Comment
খুব ভালো লিখেছেন স্যার, নতুন তথ্য পেয়ে সমৃদ্ধ হলাম 🙏