কালো পোশাক পরলে তাঁকে দুর্দান্ত দেখাত। এমনিতেই স্মার্ট। তার ওপর গায়ের উজ্জ্বল রঙে কালো পোশাক আরও ফুটত। পাবলিক প্লেসে চোখের সামনে ওই রকম একখানা ঝকঝকে চেহারা দেখে মহিলারা নাকি আকছার দুর্ঘটনা ঘটাতেন। নিজেদের সামলাতে না পেরে বাড়ির ছাদ অথবা বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে। তাঁর এই জনপ্রিয়তার বহর দেখে মুম্বই আদালত হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। তাঁর কালো পোশাক পরায় মুম্বই আদালত নিষেধাজ্ঞা জারি করে জানায়, তিনি তাঁর ইচ্ছে মতো যা খুশী পোশাক পরুন কিন্তু তিনি যেন কালো পোশাক পরে রাস্তায় না নামেন। এটাকে এক রকম ভাবে ফতোয়াই বলা যায়। আর সেই ফতোয়াটি যাঁর উদ্দেশে তিনি হলেন ‘গ্রেগরি পেক অব ইন্ডিয়া’ অথবা ভারতীয় সিনেমার চিরসবুজ নায়ক দেব আনন্দ।
ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে হঠাৎই ফিল্মের ভূত মাথায় চাপে অশোক কুমারের একটি ছবি দেখে। তখন তিনি লাহৌর কলেজের কলা বিভাগের ধরমদেব পিশোরিমল আনন্দ। যদিও আনন্দ পরিবারে প্রথম সিনেমা বা থিয়েটারে আগ্রহী হন তাঁর দাদা চেতন আনন্দ। পরবর্তীতে যিনি ফিল্ম প্রযোজক এবং পরিচালক হন। চল্লিশের দশকের শুরুতে তিনি প্রথম গুরদাসপুর ছেড়ে বম্বে পা়ড়ি দেন। কিছু দিন পর দেব আনন্দ দাদার কাছে বম্বে পৌঁছে দাদার সঙ্গে চওলের ঘুপচি ঘরে থাকতে শুরু করেন। পরিচালকের দরজায় গিয়ে ছবিতে কাজের সুযোগ পে্তে নিজেকে পরিচিত করানো শুরু করেন।
ফিল্মে কাজ পাওয়ার আগে পেট চালাতে দেব আনন্দ প্রথমে মিলিটারি পোস্টাল সার্ভিসে মাসে ৪৫ টাকা বেতনের চাকরি পান। পরে দাদা চেতনের সঙ্গে একটি থিয়েটারের দলেও নাম লেখান। সেখানেই দেখা বাবু রাও পাইয়ের সঙ্গে। দেব তাঁর কাছে ফিল্মে কাজের সুযোগ চেয়েছিলেন। শোনা যায় দেব আনন্দের অভিনয়ের থেকেও বাবু রাও বেশি তাঁর হাসি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওই হাসি দেখতেই দর্শক হলে আসবে। মাসে ৪০০ টাকার চুক্তিতে তাঁকে তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন। প্রথম ছবি ‘হাম এক হ্যায়’।
তবে দেব আনন্দের প্রবল উত্থান ৫০-এর দশকের শেষে। দেব আনন্দ দাদা চেতনের সঙ্গে প্রযোজনা সংস্থা ‘নবকেতন ফিল্মস’ খোলেন। একের পর এক হিট ছবিও হয়েছে। ‘৭০-এ দেব আনন্দ যখন প্রায় ৫০ তখনও তার ছবি ‘জনি মেরা নাম’ সুপারহিট। তার আগের কয়েক বছরে ‘জুয়েল থিফ’, ‘গাইড’-এর মতো ছবিও হিট করেছে। পরের বছর ১৯৭১-এ সুপারহিট হয় ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’। ৮০-র দশকে দেব আনন্দের বয়স যখন ৬০ তখনও বহু ছবির নায়ক। অথচ তাঁর সমসাময়িক দিলীপ কুমার তত দিনে ছবি করা কমিয়ে দিয়েছেন। রাজ কপূর তো ছবির কাজ ছেড়েই দিয়েছেন। ছবির সংখ্যার নিরিখেও দেব আনন্দ এঁদের থেকে অনেক এগিয়ে, ১১৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সেখানে দিলীপ কুমার অভিনয় করেছেন ৪৮টি ছবিতে আর রাজ কাপুর ৩০টিতে।
দেব আনন্দ বাংলা ছবি করতে কলকাতায় না এলেও তাঁর ছবি যখনই কলকাতায় মুক্তি পেয়েছে, তখন একাধিকবার তিনি এই শহরে এসেছেন । ১৯৫১ সালে ‘বাজি’ ছবির কলকাতা প্রিমিয়ারে আসেন গুরু দত্তের সঙ্গে। ১৯৫৪ সালে ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবির প্রিমিয়ারে, ‘রক্সি’ সিনেমা হলে দেব আনন্দকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন পরিচালক অজয় কর। এরপর ‘সিআইডি, ‘হাম দোনো, ‘তেরে ঘরকে সামনে, ‘গাইড, ‘জুয়েল থিফ, ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণ, ’হীরা পান্না’ ছবির প্রচারে তিলোত্তমায় পা রেখেছেন দেব আনন্দ। দেব আনন্দ ছিলেন উত্তমকুমারের ছবির ভক্ত। কিন্তু উত্তমকুমারের হিন্দি ফিল্মে আসা খুব একটা পছন্দ ছিল না তাঁর। তবে উত্তমকুমারের সুপারহিট ছবি ‘সবার উপরে’-র হিন্দি রিমেক ‘কালা পানি’, উত্তম-সুপ্রিয়া-সাবিত্রীর ‘উত্তরায়ণ’ ছবির হিন্দি রিমেক ‘হাম দোনো’ তে অভিনয় করেন। দেব আনন্দ সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘বোম্বাই কা বাবু’ ও ‘সারহাদ’ ছবিতেও অভিনয় করেন। সুপ্রিয়াকেও দেব তাঁর ‘তিন দেবিয়াঁ’ ছবির নায়িকা করতে আগ্রহী ছিলেন।কিন্তু উত্তমকুমার চাননি, তাই শেষ অবধি তা আর হয়নি। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘আসলি নকলি’তে দেব আনন্দের বোনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সন্ধ্যা রায়। দেব আনন্দ সত্যজিৎ রায়ের ছবির ভক্ত ছিলেন। দেব আনন্দ চেয়েছিলেন তাঁর নবকেতন ফিল্মসে একটি ইংরাজি ছবি বানান সত্যজিৎ রায়। সেই মতো অফারও দেন সত্যজিৎকে। কিন্তু তখন সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘চারুলতা’ তৈরীর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তবে ১৯৬৬ সালের ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অনুষ্ঠানে দেব আনন্দের ‘গাইড’ দেখে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন ‘ভারতীয় ছবির ইতিহাসে ‘গাইড’ দৃষ্টান্তমূলক কাজ’।