(গত সংখ্যার পর)
ঘুম থেকে ধড়মড় করে উঠে পড়লো আনন্দময়ী। চারিদিকে আজ শুধুই স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে। রোদ ঝলমল আকাশ। বারান্দা ভেদ করে পূবের জানালা দিয়ে রোদ ঢুকে পড়েছে বিছানায়। দক্ষিনের জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় গন্ধেশ্বরী নদীর জলাধার আর মূল সড়ক। নদীর চরে, দুই পাড়ে কাশফুলের সমারোহ। সকাল থেকেই ফিঙে, বসন্তবৌরি, দোয়েল ঘুঘু’র সমবেত ডাক শুনে ঘুম ভাঙে। প্রতিদিন সকালেই চাষী, রাখালদের কর্মব্যস্ততার ছবি খোলা জানালা থেকে দেখা যায়। মনের ক্যানভাসে আঁকা হয়ে যায় এই রঙিন দৃশ্যপট। এই তো আর ক’দিন পরেই আনন্দময়ী মায়ের আগমনকে ঘিরে শুরু হবে তুমুল প্রস্তুতি। ঘর দোর থেকে দুর্গাদালান, চন্ডীমন্ডপ সহ গোটা গ্ৰাম সেজে উঠবে নতুন করে। মাটির ঘরগুলোতে প্রলেপ পড়বে ধবধবে সাদা খড়িমাটির। সঙ্গে গেরুয়া মাটি দিয়ে আঁকাজোকা হবে ফুল, লতাপাতা আর নানান বৈচিত্র্যময় নকশা। চূড়ান্ত সময় এলেই লেখা হবে দুর্গানাম। দরজার উপরে এবং বাইরের দেওয়ালে- স্বাগতম জানিয়ে আরও লেখা হবে-“এসো মা আনন্দময়ী এ দীনের কুটিরে”। সিন্দুরের টিপ, আলতা দিয়ে আঁকা হবে মায়ের দু’টি রাঙা পা। পাশাপাশি থাকবে শ্রীশ্রী মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ।
সাতসকালেই আনন্দময়ীর মনে ভেসে উঠছে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার স্মৃতি। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে সেও ঝুড়ি কিম্বা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে চলে যেত মনিপুরের খড়ি খাদানে। দলে দলে নানা বয়সের মানুষ চলে আসত খড়ি মাটি সংগ্রহ করতে। যদিও গ্ৰামে গ্ৰামে খড়িমাটি বেচতে আসতো ফেরিওয়ালারা। সামান্য দামে ঘরে বসেই মিলত গাঁয়ের মানুষের প্রিয় এই মাটি। বাবা মা এমনকি দাদার কাছে বকুনি আর মারও খেয়েছে আনন্দময়ী। পদ্মপুকুরে ডুব সাঁতার দিয়ে তুলে আনতো পদ্ম আর শালুক ফুল। এই নিয়েও ঘরে কম অশান্তি হত না। সেই দিনগুলোই কত ভালো ছিল। মনের অন্দরে হাসির ঝিলিক খেলে গেল তার। নাহ্! এবার বিছানা তুলে তাকে শুরু করতে হবে সংসারের খাতায় লেখা নিত্য দিনের কাজ। নিজের বাড়ির মতো স্বাধীনতা না থাকলেও এখানে খুব একটা বাধা বিপত্তিও নেই। সাতসকালে নিজের কাজগুলো সেরে নিতে হয় ঝটপট। তার পর বাসি কাপড় চোপড় খুলে স্নান সেরে মন্দিরের কাজগুলো করতে হয়। যদিও মন্দিরের সেবাইত গৌরহরি কোনও তাড়া দেননি কোনো দিন।প্রথম প্রথম জড়তা মাখা লজ্জায় ঢেকে রাখতো নিজেকে। তারপর আপনা থেকেই মনের বাঁধনগুলো খুলতে লাগল একে একে। প্রথম দিকে এই গৌরবর্ণ, টিকালো নাক আর টানা টানা চোখের মালিক গৌরকে মনে হতো রহস্যময় পুরুষ। কিছুদিন পর নিজেই রহস্য মোচন করে ফেলেছে গোরার মন মনন ও চিন্তাধারার। মাথায় মেয়েদের মতো কালো ঘন চুল আর মাঝখানে চূড়া বাঁধা। কপালে তিলক আর রসকলি আঁকা। গায়ে হলদেটে রঙের নামাবলী। তার মধ্যে একটি দৈবীভাব কিম্বা সাধকের ছাপ স্পষ্ট। কখনো সখনো মুখোমুখি আর চোখাচোখি হলে দু’জনেরই অসহায়তার ছবি ফুটে উঠত মুখমন্ডল জুড়ে। অব্যাক্ত বেদনায় রাঙা হয়ে উঠতো তাদের মুখ। এই বাড়ির কুলদেবতা ও রঘুনাথজীউ মন্দিরের একজন মামুলি সেবাইত নন এই গোরা! আনন্দময়ীর ভেতরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধগুলো আজ জলের বুদ্বুদ এর মতো চাগিয়ে উঠছে। এখনো সময় আছে এই সাধক যুবকের হৃদয়ের আগল ভেঙে অব্যাক্ত বেদানার অক্ষর কিম্বা বর্ণমালা গুলো পড়ে নেওয়ার। আরও একটা বিষয় উঁকি ঝুঁকি মারছে আরাধ্য দেবতার সেবাইতকে ঘিরে। এক পা এগোয় তো আর এক পা পিছোয় ঠাকুরের সেবাদাসী আনন্দময়ী। মনের মধ্যে কি জানি কোনও পাপবোধ থেকে এই কু-চিন্তা আসছে! প্রতিদিন গৌরহরি এসে যতক্ষণ থাকেন মন্দির চত্বরে ঠিক ততক্ষণই ঠায় বসে দাঁড়িয়ে থাকেন ছোট পিসিমনি কানন। কিসের জন্য, কি স্বার্থ নিয়ে, কোন্ অজানা টানে থাকেন কানন পিসিমা। আনন্দময়ী ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে, বিলীন হয়ে যাচ্ছেন রঘুনাথজীউ, গোপাল জীউ এর রাতুল চরণে। চোখ বন্ধ করে আরও স্পষ্ট দেখতে পেল ব্রজধাম থেকে শ্রীশ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু চলেছেন নিলাচলের সমুদ্র বেলায়। মুখে শ্রী নাম গাইতে গাইতে উদ্বাহু হয়ে হেঁটে চলেছেন সামনের নীলপ্রান্তরে। কি সুন্দর অনিন্দ্য কান্তি তাঁর! নাম মাহাত্ম্যের গুণে সোনার বর্ণ গোরার ক্ষীণতনু থেকে ঝরে পড়ছে এক অনির্বচনীয় রূপ রস ও গন্ধ। আজ আর ডুকরে ডুকরে নয় হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো আনন্দময়ী।
জয়দেব ধাম, নবদ্বীপ, পুরী, মথুরা, বৃন্দাবন, গয়া, কাশীধামের মাহাত্ম্য কথা শুনেছে। বইয়ে পড়েছে সে। বড় হয়ে বাবার কাছে শুনেছে ঘরে বসেও পুণ্যের ফল পাওয়া যায়। যদি সাধন ভজন, পূজা আরাধনা ঠিক পথে থাকে তবেই মিলবে এই মহার্ঘ মার্গের দর্শন। বাবা ছাড়াও আর একজনের কথা মনে পড়ছে আনন্দময়ীর। তিনি হলেন অগ্ৰদ্বীপের সাধক অঘোরি বাবার কথা। সেখানকার শ্রীশ্রী প্রভূ গোপাল দাসের মোচ্ছবের আগে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে তাদের গ্ৰামে এসে কয়েকটি দিন কাটিয়ে যেতেন অঘোরি আশ্রম ও আখড়ার এই সাধু মহারাজ। দান দক্ষিণা আদায় আর শ্রীপাটের ভক্ত, শিষ্যদের কাছে বাৎসরিক মাধুকরী সংগ্ৰহ করতেন। যারা যারা যেতে আগ্ৰহী তাদের নাম ও যাত্রী সঙ্খ্যা লিখে নিতেন। এই ধামের লীলা মাহাত্ম্য শুনেছে এ বাড়ির ছোট পিসিমনি কাননদাসীর মুখে। এই কাননদাসীরও কপাল পুড়েছিল ছোটবেলায়। পুতুল খেলার বয়স ছেড়ে কানন পিসি কিশোরী থেকে যুবতীর দুয়ারে পৌঁছেই পেলেন বিয়ের গুঞ্জন আর গন্ধ। কাননের মা একটু কিন্তু কিন্তু করেছিলেন। তবুও বাড়ি শুদ্ধু লোক খুশিতে ডগমগ। মেজো জেঠাইমা তো হেঁকে ডেকে বলেই দিলেন, কানন তো আর জজপন্ডিত কিম্বা “কাদম্বিনী “হবে না! ওকে ঘরসংসার করতে হবে তো নাকি? বাড়ির কর্তা ইন্দ্রনারায়ণ বাবু সম্বন্ধ ঠিক করলেন এক পরিচিত ঘটকের মাধ্যমে। বর্ধমানের শ্যামসুন্দর একটি বড়গ্ৰাম। এখানকার রায়চৌধুরী পরিবারের নামডাক আছে। এলাকায় তাদের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি আজও বজায় রয়েছে। অগত্যা সবাইকে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হল। আর কানন? সে তো তাঁতের ফুলাম পেড়ে শাড়িকে গাছকোমর বেঁধে চুলের ঝুঁটি দুলিয়ে নেচে নেচে বেড়ায়। দুই পায়ের মল ঝুম ঝুম করে বেজে উঠতো। পাড়ার মেয়ে বন্ধুদের মনে বিষাদের ছায়া। দু’একজন ছেলেবন্ধুদেরও কাননের বিয়ের খবরটা শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। তাদের কাছে কানন ছিল মুস্কিল আসান। কিশোর বেলায় দোল খাওয়া, চু কিত্ কিত্, বর বউ খেলা থেকে আম, পেয়ারা, কুল, খেজুর এমনকি গাঙ্গুলি বাড়ির কয়েত্ বেল, কামরাঙা চুরিতে কাননের জুড়ি মেলা ভার। নিজের বাড়ি ছাড়াও পাড়া ঘরের লোকজন তাকে ডাকাত মেয়ে বলেই ডাকা হাঁকা করতো। এ হেন কাননও নিজের ভালো মন্দ বোঝার আগেই চলে যাবে পরের বাড়ি।
আনন্দময়ী ছোট পিসিমনি কাননের জীবনের গল্প শুনতে চায় নিজের মতো করে। তারও কি অকাল বৈধব্যের জ্বালা যন্ত্রনা জমে আছে হৃদয়ের সংগোপনে? তারও কি পাথর চাপা হয়ে জমাট বেঁধে আছে দুঃখের আগুন? কিন্তু তাঁকে দেখে তো বজ্রকঠোর মনের মহিলা বলেই মনে করে আনন্দময়ী। তবে কি অন্তরঙ্গ বহিরঙ্গের মোড়ক আলাদা আলাদা। বেশ কিছুদিন এই বাড়িতে কাটানো হয়ে গেল আনন্দময়ীর। এখনো শক্ত ধাতের কাননকে ততটা জেনে ও পড়ে উঠতে পারেনি সে। অবিরাম পাখির ডাক মোহময়ী করে তুলেছে ভাদ্রের গুমোট হয়ে থাকা সকালবেলাকে। পায়ে পায়ে ধূলো উড়িয়ে আপনমনে চলেছে গাঁ ঘরের গাই গরুর দল। বাউরি পাড়ার লখাই এই গরুর পালের বাগাল। মাথায় না ছাড়ানো ঝাঁকড়া চুল। আবার সেই চুলকে আরও স্টাইল করে হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো রয়েছে।