গির্জা শব্দটির ইংরেজি শব্দ চার্চ। গ্রিক ভাষার ঈশ্বরের মন্দির থেকে চার্চ শব্দ এসেছে। তবে বাইবেলে গির্জা শব্দটি নেই। চার্চ বা গির্জায় প্রভু যিশুর অনুসরণকারীদের ধর্ম বোঝানো হয়। যেমন– ক্যাথলিক চার্চ, প্রটেস্টান্ট চার্চ ও অর্থোডক্স চার্চ।
অগাস্টিয়ান জেসুইটরা সতেরো শতকের প্রথম দিকে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতেন। পূর্ব ভারতের পুরোনো চার্চ মুর্শিদাবাদের সৈয়দাবাদে বহরমপুরে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে একটি আর্মেনীয় গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়।
লন্ডনের ট্রাফলগার স্কোয়ারে বিখ্যাত গির্জা সেন্ট মার্টিন ইন দ্য ফিল্ডস চার্চের মতো তৈরি কলকাতার সেন্ট জনস চার্চ। এটি ক্যাথিড্রাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেন্ট জন’স চার্চ কলকাতায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা প্রথম স্থাপিত ভবনগুলির মধ্যে একটি। এই গির্জার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৭৮৪ সালে। পাবলিক লটারির মাধ্যমে ৩০,০০০ টাকা তোলা হয়েছিল, এর কাজ শেষ হয় ১৭৮৭ সালে। সেন্ট জন’স চার্চ কলকাতার তৃতীয় সবচেয়ে পুরনো (আর্মেনিয়ান গির্জা ও ওল্ড মিশন চার্চের পরে) । ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত সেন্ট জন’স চার্চ ছিল কলকাতার অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রাল। এই চার্চটিকে বাংলা তথা ভারতের প্রথম ক্যাথিড্রাল চার্চ বলা হয়। বাংলার বেশিরভাগ চার্চ এরই অনুকরণে নির্মিত হয়েছে। তারপর সেন্ট পল’স চার্চে কলকাতার ক্যাথিড্রাল স্থানান্তরিত হয়। সেন্ট জন’স চার্চটি লন্ডনের সেন্ট মার্টিন-ইন-দ্য-ফিল্ডস চার্চের আদলে নির্মিত। সেন্ট মার্টিন ইন দ্য ফিল্ড রোমানদের আমলে তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হয়, ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় নির্মাণ করেন ইংল্যান্ডের অষ্টম হেনরি। পরে এটি কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে টমাস জাবিবুক নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে আসেন। সেখানে তিনিই প্রথম ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি উপাসনালয় গঠন করেন। কিন্তু তাঁর অসুস্থতার কারণে তিনি সেটি বন্ধ করতে বাধ্য হন। পরবর্তিতে সেটি একটি ডিসপেনসারিতে রূপান্তরিত হয়। দশ বছর পর ফাদার মিলন বেঙ্গল মিশনে কাজ করতে আসেন। তিনি ডিসপেনসারিটাকে ফেরত চান। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষ আবার জড়ো হয়। ১৮৮৬সালে ১লা সেপ্টেম্বর উপসনা গৃহটির পরিচালনার জন্য প্রথম বিশপ নিযুক্ত হন ফ্রান্সিস পোজি। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে চার্চটি সরকারী নাম পায় “কৃষ্ণনগর রোমান ক্যাথলিক ডায়োসিস”। যদিও এটি এখন ‘ক্যাথলিক চার্চ’ নামে পরিচিত। চার্চটিতে ল্যাটিন রীতি মানা হয়।
১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে চার্চটি ধ্বংস হয়ে যায়। দু-বছরের মধ্যে, বিশপ পোজির প্রচেষ্টায় বর্তমানের নতুন ক্যাথেড্রাল চার্চটি নির্মিত হয় এবং খোলা হয় ১৯শে মার্চ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে। যা এখন বাংলার অন্যতম চার্চ হিসাবে বিবেচিত। ইউরোপীয় ও ভারতীয় শৈলীর মেলবন্ধনে এটি তৈরি হয়। সামনের অংশটি চারটি স্তম্ভ বা পিলার দ্বারা নির্মিত। এই স্তম্ভগুলিতে সুন্দর নকশা আছে। নিচে দুটি রোমান খিলান। চার্চের চূড়ায় হাতে ক্রুশ ধরা যিশুর মূর্তি। চার্চের শীর্ষের এই যিশু মূর্তিটির নির্মাতা সুবিখ্যাত শিল্পী বীরেন পাল। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী বীরেনবাবুর বিশেষ খ্যাতি ছিল যিশুর মূর্তি নির্মাণে।
নকশার নিচে বাংলায় খোদাই করা ”ঈশ্বরের গৃহ-স্বর্গের দ্বার”। চার্চের ভিতরে অনেক তৈলচিত্র এবং কিছু মদ ও আসবাবপত্র। যিশু, মেরি এবং অন্যান্যদের মূর্তি রয়েছে।চার্চের গেটের উল্লোদিকে ”খ্রিস্ট মন্দির” নামে একটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করা হয় ২০০৯ সালে। এটি প্রার্থনা ও প্রদর্শনী হল, যা ধর্মীয় ও সামাজিক ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো। মন্দিরের বাইরের দেয়ালে সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট পলস, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার, সেন্ট জেমস প্রভৃতি খ্রিস্ট-সাধুদের মূর্তি আছে।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাথিড্রাল চার্চটি ডন বস্কোর সেলসিয়ানদের হাতে যায়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে মেরি হেল্প ফিস্ট ডন বস্কোর সেলসিয়ানরা উপাসনা গৃহটি পাদ্রীদের দিয়েছে। চার্চে ক্যাথলিক পুরোহিত আছেন ৩৪জন, উপাসনা গৃহের পুরোহিত আছেন ৩৮জন, সিস্টার আছেন ৩৫২ জন। চার্চে বড়দিন উপলক্ষে মেলা বসে। মেলায় প্রচুর দোকান বসে। ২৫শে ডিসেম্বর থেকে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। বহু লোক সমাগম হয়। কৃষ্ণনগরে বড়দিনের মেলা একটি বড় উৎসব।
1 Comment
অনেক কিছু তথ্য তুমি নতুন করে জানার সুযোগ এনে দিলে।তোমাকে ধন্যবাদ জানালে ভুল হবে, তোমার এ কাজের জন্য কৃতজ্ঞতাই জানাতে হয়।