পর্ব-৪
গানকে বড় করে উঠতে দিলে প্রেমে ধুলো পড়ে, প্রেমকে বড় করে দেখলে ধুলো পড়ে তানপুরায়। ক্রমশঃ গীতিকার মেয়েটি ডুবে যাচ্ছে জাগতিক গণিতে। হারমোনিয়ামের রিডে হাত বিরল, হাতে কলম, কিন্তু কলমে গানের লিরিকের চেয়ে হিসাবের সিঁড়ি ভাঙ্গা অঙ্ক যেন দিনে দিনে আরও বেশি। যে কবিতাগুলি লেখা দানা বাঁধে বুকে, যে সুর গুলি গুণগুণ করে গলায়, যে নৃত্যছন্দ রিনরিন করে নূপুরে সেই মেয়েটি কই?
সুর থেকে আলোর রোশনাই ঝরিয়ে দিয়ে শুকতারা খসে পড়ে দিকচক্রবালে। মীরা, মীরা, মীরা, এমন বিলিয়ে দিতে দিতে হারিয়ে যেও না তুমি।
দোষ মীরার নয়, দোষ সেই যুগের। সে যুগে নারী অদ্বিতীয়া হয়েও তারা দ্বিতীয় শ্রেণীতে সাবলীল, স্বামীর অনুগামিনী হিসেবে সামাজিক, অনুসরণে যথার্থ। স্ত্রীর যোগ্যতা যতই বেশি হোক, তার নিস্প্রভ হয়ে থাকাই মানানসই ও সুদৃশ।
মীরাও তাই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে প্রতিভাবান স্বামী ও পুত্রের উজ্জ্বলতার মশালটিতে জ্বালানির যোগান দিতেই বেশি উৎসাহী। এ সুখ নারীর ত্যাগের, নারীর মহত্ত্বের, বিশাল মহীরুহের শিকড়স্বরূপা হয়ে রসদা হয়ে বেঁচে থাকার তীব্র গৌরবের। মীরা তা করে দেখিয়েছেন।
তাই আমরা সুরের জগতের বিশাল দুই মহীরুহ শচীন দেব ও রাহুল দেব কে পেলাম যাঁরা আজও তাঁদের কীর্তির মধ্য দিয়ে শাখাপ্রশাখা প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন চিরসবুজ খ্যাতি আর সম্মানের ধ্বজা উড়িয়ে।
কিন্তু তাঁদের জীবনরস প্রদায়িনী শিকড় মীরা দাশগুপ্তকে দেখতে পাই না, খুঁজে পেতে হলে অনেক শ্রম করতে হয়, তিনি যে মাটির নীচে চিরবিস্তৃত হয়ে আজও অনন্তে প্রসারিত তাঁর লেখা গান গুলির আখরে আখরে।
ডালি ডালি ফুল খিলে রুদাই বহত হি
আগন লাগি হ্যায় মেরি মন মেঁ,
কিসি কী আগন লাগি হ্যায় মেরি মন মেঁ, গগন পেঁ ছায়ি কারি ঘটা ঝুম ঝুম কে, পবন সাতায়েঁ মোরে মুখ চুম চুম কে, ডগমগ ডগমগ নাইয়া মেরে প্যার কে ডুব না যাঁয়ে আ
তেরে লিয়ে খোলে ম্যায়নে পলকোঁ কে দ্বার, তুঝ কো বুলায়েঁ মেরে গীতোঁ কী পুকার…
অথবা,
রাতের আতরে ভিজাইয়া আদরে
কেন বঁধু দূরে যাও,
চাতুরীতে ভুলে ছিলাম, ভুলে ছিলাম,
মান করে আর লাভ নাই,
ভালবাসা দেয়া হল দায়।
যে শিকারি সাকী, ছিল চোরাপাখি,
মন চুরি করে উড়ে যায়,
রাঙা এ গোলাপে, ভুলায়ে প্রলাপে
পেয়ালা সে খালি রেখে যায়,
চাতুরীতে ভুলে ছিলাম, মান করে আর লাভ নাই,
ভালবাসা দেয়া হলো দায়।
পিয়াসি চাতকী, আসিয়া একাকী,
বিষ ঢেলে সুধা নিয়ে যায়,
লিখে আগুনেতে, ক্ষনিক বাসনাতে পীরিতি আদুরী রেখে যায়,
চাতুরীতে ভুলে ছিলাম, ভুলে ছিলাম,
মান করে আর লাভ নাই,
ভালবাসা দেয়া হলো দায়।
কী অপূর্ব রোমান্টিক লেখনী আর কী সহজ উচ্চারণ। গীতিকার কি নিজের কথা ব্যক্ত করেন তাঁর লেখায়, নাকি নিজের আয়নায় দেখতে পান হাজার মানুষের মন, তাই তিনি সার্বজনীন, তাই তিনি গানের শব্দে অমর, হাজার প্রাণের সাথে একাত্মতায়।।
কিন্তু আলাদা স্বীকৃতি বা আলাদা সম্মানের, আলাদা করে পায়ের তলার মাটির যে প্রয়োজন আছে। জীবন কি সারাজীবন একই ছন্দে চলে?
(চলবে)