তিনি মহাপরিব্রাজক। জীবনভর এক থেকে আর এক। এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে, এক নাম ছেড়ে আরেক নাম, এক স্ত্রীকে ছেড়ে আর এক স্ত্রী, এক রাজনীতি থেকে আরেক রাজনীতি, এক দেশ থেকে আরেক দেশ…চলেছেন আর চলেছেন। কেবল চলা আর চলা… তাতেও তৃপ্ত হন নি। আসলে যা খুঁজেছেন, পেতে চেয়েছেন আর পেয়েছেন, মনে প্রশ্ন ভেসে উঠলেই তার উত্তরের খোঁজে ফের চলতে শুরু করেছেন।
মঠের সন্ন্যাসী কেদারনাথ কৃষকদের কাছে গিয়ে তাঁদের জীবন যন্ত্রণার কথা শুনতে থাকলেন, রক্তাক্ত হলেন। কেদার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। দেশে স্বাধীনতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ- মুজফফরপুরে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকি… ক্ষুদিরামের ফাঁসি, দিল্লিতে লর্ড কার্জনের উপর বোমার হামলা থেকে শুরু করে জালিয়ানওয়ালাবাগ তাঁকে নাড়িয়ে দিল। চম্পারণ সত্যাগ্রহের পর কেদারনাথ যোগ দিলেন কংগ্রেসে। কংগ্রেসের আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীটিকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে বক্সার জেলে ছমাস বন্দি রাখল।জেল থেকে বেরিয়ে কেদারনাথ জেলা কংগ্রেসের সভাপতি হলেন।
কিন্তু রাজনীতিতে থেকেও কেদারের মনে অজস্র প্রশ্ন, শাক্ত-বৈষ্ণবের দ্বন্দ্ব। সমাধান না পেয়ে ঝুঁকলেন কিষাণ আন্দোলনে, গেলেন সংগঠক বন্ধুপ্রবর আর্যসমাজের স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর কাছে। হিন্দু ধর্ম ছেড়ে যোগ দিলেন আর্যসমাজে। নাম বদলে হলেন রামা উদার সাধু। তিন বছর জেলে থাকাকালীন সংস্কৃতে অনুবাদ করলেন পবিত্র কুরআন শরীফ। ছাড়া পেয়ে বিহারে রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করলেন। কিন্তু কংগ্রেসের কাজকর্ম নিয়েও তাঁর মনে নানা প্রশ্ন। কংগ্রেসের একদল তখন স্বরাজ আর একটি সমাজবাদী শিবির। আর্যসমাজের দর্শন ও তার সীমাবদ্ধতা নিয়েও তাঁর মনে প্রশ্ন।
লখনউতে কংগ্রেস অধিবেশন। গড়ে উঠল ‘সারা ভারত কৃষক সভা’, নেতৃত্বে এলেন কেদারনাথ ওরফে রামা উদার। ১৯২৫ সালে তৈরি হল কমিউনিস্ট পার্টি, রাম উদার যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তাঁর পার্টি সদস্যপদ বাতিল হল। তবে লেগে থাকলেন পার্টির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনে, সেইকারণে দেউলি ও হাজারিবাগ জেলে বন্দি হলেন। পরে ফের তিনি পার্টির সদস্যপদ ফিরেও পেলেন।
এদিকে নানা প্রশ্নযার উত্তর শাক্ত মতে পাননি, বৈষ্ণবে পাননি, আর্যসমাজেও না-অনুসন্ধানে তিনি চলে গেলেন অন্য দিশায়। দীর্ঘদিন বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করে পেলেন বহু প্রশ্নের উত্তর। ধর্ম পরিবর্তন করে হলেন বৌদ্ধ। এবার নাম নিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। রাহুল অর্থাৎ বুদ্ধ-পুত্র। সাংকৃত্যায়ন-যিনি কিছু সৎ কাজ, ভাল কাজ করতে চান। একদিকে মার্কসীয় বস্তুবাদ, অন্যদিকে বৌদ্ধদর্শন জ্ঞানতপস্বীর জীবন কাটিয়েওরাহুল সাংকৃত্যায়ন বৌদ্ধ ভিক্ষু হননি। মুক্তচিন্তক রাহুল সাংকৃত্যায়নকে ধর্মীয় গোঁড়ামিও ছুঁতে পারেনি।
বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে জ্ঞানার্জনে চারবার পদব্রজে তিব্বত গিয়েছেন। আবিস্কার করেছেন ৩৬৮টির মত পুঁথি, যার অনেকগুলিই তিনি ভারতে এনেছিলেন। এছাড়া তুলে এনেছিলেন ৫৫টির মতো পুঁথির আলোকচিত্র। বই, পুঁথি ও দস্তাবেজ আনার জন্য তাঁকে ২২টি গাধা ভাড়া করতে হয়েছিল। পাটনা মিউজিয়ামে ‘রাহুল’ বিভাগে আছে সেসব। আছে সিংহ সেনাপতি বইটির মুল নথি। পালি ভাষা থেকে অনেকগুলি বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন তিনি, যার মধ্যে বসুবন্ধু রচিত ‘অভিধর্ম কোষ’, ‘খুদ্দক পাঠ’, ‘গুনপ্রভ রচিত ‘বিনয় সূত্র’, ‘মহাপরিনির্বানসূত্র’ অন্যতম।
৭০ বছরের জীবনে দেশ ও বিদেশ ভ্রমণের কেটেছ ৪৫ বছর। শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, ইউরোপের নানা দেশ, চিন, নেপাল আর চার চারবার তিব্বত সফর। শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ শাস্ত্র পড়িয়েছেন, লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য গিয়েছেন দুবার। রাশিয়ায় আলাপ হয় লোলা ওরফে এলেনা নারভের্তোভনা কোজেরভস্কায়ার সঙ্গে।লোলাকেবল ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, সংস্কৃত ও ইংরেজী জানতেন, লিখতে পারতেন সংস্কৃতে। রাহুল আর লোলা তিব্বতি-সংস্কৃত অভিধান রচনা কালেই বিয়ে করেন। কিন্তুদেশে ফেরার সময় স্ট্যালিনের নেতৃত্ব লোলার ভারতে আসায় আপত্তি জানায়। চোখের জলে রাহুলকে একাই ফিরতে হয়। এ নিয়ে রাহুলের লেখা একটি অসাধারণ উপন্যাস আছে ‘উত্তরপুরুষ’।
রাশিয়া থেকে ফিরে আর একবার পায়ে হেঁটে তিব্বত যান। নেপাল হয়ে ফেরার সময় দার্জিলিং-এ এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই সময় তাঁকে দেখভাল করেছিলেন কমলা নামে এক তরুণী অধ্যাপিকা। ফের রাহুল প্রেমে ভাসেন, বিয়ে করেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, শাক্ত থেকে বৌদ্ধ এবং কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্ট,সন্তোষী থেকে লোলা হয়ে কমলা– এ সবের পিছনেও তাঁর চলা আর খোঁজজ্ঞানের, দর্শনের। হিমালয়ের দুর্গম পার্বত্য পথ একা মাইলের পর মাইল হাঁটা শুধু বৌদ্ধ শাস্ত্র রাশির সন্ধানে। অতীশ দীপঙ্করের পর আর কী কেউ করেছেন, ইরান থেকে বর্তমান বাংলাদেশের ঘরসংসার ফেলে কেউ কী চষে বেড়িয়েছেন?