লোকে বলে বাঙালি পাঁচ টাকার মদ খেয়ে দশ টাকার মাতলামি করে। খুব ভুল কিছুও বলে না। এমন অভিজ্ঞতা হাটে বাজারে রাস্তায়-ঘাটে, বেড়াতে গিয়ে অল্পবিস্তর হয়েছে আমার। নাহ্, ” মদ্যপানের বিরূদ্ধে যারা তাদের মাথায় পড়ুক বাজ”… বলে গুনগুন গাইতে হবে না। আমি মদ পানের বিরোধী নই। মাতলামি বিরক্তিকর। মাতালদের টলমল দেখতে কেমন ভয় ভয় করে। মনে হয় এই এক্ষুনি গায়ের উপর এসে পড়বে।
আমার এও মনে হয় মদ্যপায়ীদের অনেকেই জানেন না মদ কীভাবে পান করতে হয়। হিন্দি সিনেমার সাধারণ দৃশ্য হতাশাগ্রস্থ, বিরহী নায়ক ঢক ঢক করে বোতল উজাড় ঢেলে দিলো গলায়।আহা, সেসব সিনেম্যাটিক দৃশ্যায়ন দূরে থাক।
সুরা, সোমরস ইত্যাদির প্রচলন প্রাচীন ভারতের যজ্ঞতর্পণে থাকলেও আজকের দিনে মদ বলতে যা বুঝি, তা নিয়ে এসেছিল পর্তুগিজরা। তাদের ভাষায় ‘মেডিরা’।বোধকরি মদিরা শব্দটি এসেছে এখান থেকেই।তবে মদ্যপানকে জনপ্রিয়তা ও আভিজাত্য দিয়েছে ইংরেজরা।
ইংরেজ সংস্পর্শে উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁ পুরুষরা মদে মস্ত মজেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় মদ্যপান করতেন। বাঙালির আইকন, এই আধুনিক মানুষটি কতটা নেশা করতে কতটা আভিজাত্য প্রদর্শনের জন্য মদ্যপান করতেন তা বলা মুশকিল। প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেন পাড় মাতাল। পূর্ববঙ্গের জমিদারির টাকা মদ আর মেয়েমানুষের পেছনে যে যথেষ্টই খরচ হতো তা বলাই বাহুল্য। পুত্র দেবেন্দ্রনাথও মদ্যপান করতেন।পরে অবশ্য অক্ষয়কুমার দত্তের প্রভাবে তিনি মদ্যপান ত্যাগ করেন।
রাজনারায়ণ বসু ছিলেন বেহেড মাতাল। রাজনারায়ণের বাবা মনে করতেন ছেলেকে বাড়িতে বসে ( এমনকি বাবার সঙ্গেও ) মদ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া দরকার। তাঁর যুক্তি ছিল ছেলে বাইরে গিয়ে মদ খেলে মাত্রাতিরিক্ত মদ্য পান করবে। মজার কথা হলো রাজনারায়ণ ঘরে বাইরে কোথাও মদ খাওয়ায় খামতি রাখতন না।
মাইকেল মধুসূদনের মদ্যপানের কাহিনী তো রীতিমত এপিক। ঋণ করে হলেও তিনি মদ্য পান থেকে বিরত থাকেননি। এই প্রসঙ্গে মেধার সঙ্গে মদের আন্তঃসম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করেন অনেকেই। এমনও শুনি কবি-লেখক-সেলিব্রেটি হতে নাকি পানাসক্তি বাধ্যতামূলক। যাঁরা এমন বলেন তাঁদের যুক্তিকে আরও একটু যুক্তিগ্রাহ্য করে দিতে উনিশ শতকের আরও কয়েকজন মেধাবীর নাম করা যেতে পারে… হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ,প্রতাপচন্দ্র সিংহ, দীনবন্ধু মিত্র এঁরা প্রত্যেকেই মদ্যপায়ী ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মদ্যপানে অরুচি ছিল না। তবে পুরুষ সিংহ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মদ্য পানের শখ রাখতেন এমন কোথাও পড়িনি। ঈশ্বর ছিলেন পেটরোগা। অম্ল, অজীর্ণ সম্বলিত পেটে বাড়তি চান্স নিতে চাননি হয়তো।
ইংরেজদের কাছে নিজেদের জাহির করতে এবং ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবে এক সময় হিন্দু ধর্মের কঠোরতাকে উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যেই কলকাতার নব্য শিক্ষিতরা মদ্যপানকে আভিজাত্য ও উদারতার প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করেন। পরে এর অপকারিতা বুঝতে পেরে অনেকেই সরে আসেন এবং সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনেও যোগদান করেন।
তবে মাতলামি ব্যাপারটা বাঙালির মধ্যে আগাগোড়াই কমবেশি ছিল। কারণ তারা আপ্যায়নের জন্য মদ্য পান করত না,করতো নেশা করার জন্য। আর নেশা হলে তা তো মাথায় চড়বেই।