প্রায় আড়াই দশক পর নেহরু-গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ কংগ্রেস সভাপতি হলেন। মুপন্না মল্লিকার্জুন খাড়গে ১৩৭ বছরের রাজনৈতিক দলটির যখন ৯৮তম সভাপতি নির্বাচিত হলেন তখন বিভিন্ন রাজ্যে দলের অবস্থা খুবই খারাপ। দল ছেড়ে গিয়েছেন একধিক প্রবীণ নেতা ও সংগঠক। তাছাড়া ২০১৪ সালের পর থেকে কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে একটার পর একটা নির্বাচনে কংগ্রেস হেরেই চলেছে। গান্ধী পরিবারের অনুগত খাড়গের সভাপতি পদে নির্বাচন জেতা নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না, অপেক্ষা ছিল তিনি শশী থারুরের থেকে কত ব্যবধানে জেতেন। খাগড়ের আগে ১৯৬৮ সালে কর্নাটক থেকে কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন এস নিজলিঙ্গাপ্পা। আর ১৯৯৮ সালে শেষবারের মতো কংগ্রেসের সভাপতি পদে গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ নির্বাচিত হয়েছিলেন বিহারের সীতারাম কেশরী।
ন’বার বিধানসভা এবং ২ বার লোকসভা ভোটে জেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে কর্নাটক রাজনীতিতে ‘সোলিল্লদা সরাদর’ নামে পরিচিত। কন্নড় ভাষায় যার মানে যে নেতা কখনও ভোটে হারেন না। যদিও তিনি ২০১৯-এর লোকসভায় হেরেছিলেন তবে গান্ধী পরিবারের আনুকূল্যেই গুলাম নবি আজাদের মেয়াদ শেষেরাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা হন। তার আগে পরপর তিন দফায় (১৯৯৯, ২০০৪ এবং ২০১৩ সালে কর্নাটক বিধানসভা ভোটের পর) কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেও কংগ্রেস হাইকমান্ড তাঁর জায়গায় বেছে নেয় এসএম কৃষ্ণ, এন ধর্ম সিংহ এবং সিদ্দারামাইয়াকে। এবার কংগ্রেস সভাপতি পদেও গান্ধী পরিবার প্রথমে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটকে ঠিক করেছিল, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে নারাজ গেহলট, তাই খাড়গেকে সমর্থন করে গান্ধী পরিবার।বিক্ষুব্ধ জি২৩ গোষ্ঠীর নেতা বলে পরিচিতশশী থারুর ভোটে লড়ার আগে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেও, তাকে সমর্থন জানায়নি গান্ধী পরিবার।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, ৮০ বছর বয়সি নেতা মল্লিকার্জুন খাগড়ে কি স্বাধীনভাবে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিয়ে দলের হাল ফেরাতে পারবেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, কংগ্রেস হাইকমান্ড যদি দলের হাল ফেরাতে চাইতো তাহলে তাহলে শশী থারুর সোনিয়া গান্ধীর সমর্থন পেতেন। আসলে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল বারবার যে গান্ধী পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তুলছে সেই অভিযোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য গান্ধী পরিবারের বাইরের কিন্তু অনুগত খাড়গেকে দলের সভাপতিকরা হয়েছে। খাড়গে পরিবারের কথা শুনেই কংগ্রেস দল চালাবেন। তাতে দলের রিমোট কন্ট্রোল থাকবে পরিবারের হাতেই। অন্যদিকে সুবক্তা, সুলেখক সর্বোপরি বিদ্রোহী শশী থারুর কংগ্রেসের সভাপতি হলে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে সংঘাত লেগেই থাকবে। সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভালোহলেও রিমোট কন্ট্রোল গান্ধী পরিবারের হাতে নাও থাকতে পারে।সেই কারনেগান্ধী পরিবার সেটা চায়নি। বরং খাড়গেকে সভপাতি করে কংগ্রেস বিজেপির পরিবারতন্ত্রের খোঁচা রুখে দিতে পারলো, অন্যদিকে খাড়গে যেহেতু গান্ধী পরিবারেরই প্রার্থী তাই রিমোট কন্ট্রোল গান্ধী পরিবারের হাতে থাকবে।
রাজনৈতিক মহলের অনেকের ধারণা, দলের সভাপতি পদে যেই থাকুক না কেন রাহুল গান্ধী কোনও পদে না থাকলেও তিনিই কংগ্রেসের প্রধান মুখ থাকবেন। তিনিই আসলে দলের সর্বেসর্বা। শুধু হারলে দায় বর্তাবে নতুন সভাপতির উপর। আর জিতলে কৃতিত্ব রাহুলের।২০১৯-এ মুখ থুবড়ে পড়ার পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের হাল আরও খারাপ হয়েছে। সম্প্রতি পাঞ্জাবে কংগ্রেস জোর ধাক্কা খেয়েছে। গোয়ায় শাসক-বিরোধী হাওয়া থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস জিততে পারেনি। উত্তরাখণ্ডেও সুবিধাজনক জায়গায় থেকেওকংগ্রেসকেহারতে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশেওপ্রায়মুছে গিয়েছে। দলের এই অবস্থায়নতুন সভাপতির সামনে হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাতের নির্বাচন। এতদিন এই রাজ্যে বিজেপি ও কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই হত। এবার দুই রাজ্যেই আপ নেতারা জোর প্রচার চালাচ্ছে। সামনের বছরের শুরুতেই কর্নাটকেও ভোট। সেদিক থেকে দলিত নেতাকে সর্বভারতীয় সভাপতি করে কংগ্রেস একটা মোক্ষম চাল দিয়েছে।
এখন দেখার রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দলিত ভোটে ভাগ বসাতে পারে কি না? অন্যদিকে নতুন সভাপতির সামনেও মস্তবড় চ্যালেঞ্জ,অন্তত দুই নির্বাচনে দলকে সাফল্যের সরণিতে নিয়ে আসা। কংগ্রেস দলে গান্ধী ফ্যামিলির জি হুজুরেরা আগেও ছিল, এখনও আছে। এই জি হুজুরেরা নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই জোহুজুরি করেছেন এবং করেন, তা না হলে রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী বা রাহুল গান্ধীর রাজনীতিতে আসাই সম্ভব ছিল না৷ কিন্তু ১৩৭ বছরের দলটিকে কেবলমাত্র জি হুজুরেরা চালাননি বা স্রেফ পরিবারতন্ত্রের উপরেই যে দল চলেছে তাও নয়। পরিবারতন্ত্রের ইতিহাস তো ইন্দিরা গান্ধির আমল থেকে। সেটা কংগ্রেস দলের একমাত্র না হলেও বিরাট সমস্যা। যার সমাধান শশী থারুরের পক্ষেও সম্ভব হত না।