১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪
জলখাবার’, ‘জুয়েল হাউজ’-এর সামনে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছিলেনতিনি। তখনতিনিকেবল অন্যমনস্ক নয়, কী এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন। চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম স্পটিং স্টেশন থেকে তখনো প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে। ট্রাম ড্রাইভার এক নাগাড়ে ঘণ্টা বাজান আরচিৎকার করে তাঁকে সতর্ক করে চলেন। কিন্তু যা অনিবার্য তাই ঘটলো। ট্রাম থামলো যখন, তখন তিনি প্রচন্ড এক ধাক্কা খেয়ে ক্যাচারের ভিতর ঢুকে গিয়েছেন। ক্যাচারের কবল থেকে সবাই অতি কষ্টে টেনে হিঁচড়ে বার করলেন রক্তাপ্লুত, অচেতন দেহ। কেটে, ছিঁড়ে থেঁতলে গিয়েছে শরীর...চুরমার হয়ে গিয়েছে বুকের পাঁজরা...
এই ঘটনার কয়েক বছর আগে থেকেই তিনি চরম অর্থকষ্টে ছিলেন। তুচ্ছ কারণে একটার পর একটা চাকরি হারিয়েছেন। কলকাতার ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিটের একটি ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। গোটা পরিবারের ভারে তিনি অস্থির এবং অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। নিদারুণ অর্থকষ্টে ভাড়াবাড়ির একটা ঘর অন্য একজনকে ভাড়া দিয়েছিলেন। তিনিও তাঁর লেখা পড়া, শান্তির পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছিলেন। অর্থের জন্য টিউশনি করেছেন, এমনকি বিমা কোম্পানির এজেন্টের কাজ করার চেষ্টা করেছেন। টাকা ধার করেছেন ভাই-বোন, ভাইয়ের স্ত্রী থেকে শুরু করে বিশিষ্ট মানুষদের কাছ থেকে। শোধও করেছেন অল্প অল্প করে। তাঁর পক্ষে উপযুক্ত একটা কাজের জন্য স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদককে অন্তত তিনখানা চিঠি লিখেছিলেন। তিনি কিছুই করেন নি, বা করতে পারেন নি। অবশ্য বেঘোরে মরার পর তাঁকে মরণোত্তর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারটা পাইয়ে দিয়েছিলেন।
কেউ বলেন, ‘তাঁর ডায়েরির লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তিনি মৃত্যুচিন্তায় চিন্তিত ছিলেন। এক্ষেত্রে এটা আত্মহত্যা হলেও হতে পারে’। কেউ বলেন তাঁর কবিতায় মৃত্যুময়তার প্রতি আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়- ‘পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাইগেয়ে যাই আমি, মরণেরে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী’।‘যেই ঘুম ভাঙ্গে নাকো কোনদিন ঘুমাতে ঘুমাতে সবচেয়ে সুখ আর সবচেয়ে শান্তি আছে তাতে’। ‘কোথায় রয়েছে মৃত্যু? কোনদিকে? খুঁজি আমি তারে’ ইত্যাদি…
এপ্রিল, ১৯২০
ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে/দীপ্ত-নীলে, শুভ্র রাগে / প্রভাত রবি উঠল জেগে / দিব্য পরশ পেয়ে। / নাই গগনে মেঘের ছায়া / যেন স্বচ্ছ স্বর্গ ছায়া / ভূবনভরা মুক্ত মায়া / মুগ্ধ – হৃদয় চেয়ে। / অতীত নিশি গেছে চলে, / চির-বিদায়-বার্তা ব’লে, / কোন আঁধারের গভীর তলে / রেখে স্মৃতি-লেখা। / এস এস ওগো নবীন,/ চলে গেছে জীর্ণ মলিন / আজকে তুমি মৃত্যু-বিহীন / মুক্ত-সীমা-রেখা। কবিতার নাম ‘বর্ষা-আবাহন’
বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার ২০তম বর্ষের বৈশাখ সংখ্যায় (বাংলা ১৩২৬, ইংরেজি ১৯২০)’বর্ষা আবাহন’ নামে এই কবিতাটি প্রথম দেখেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এটি দেখতে পান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। কিন্তু ওই কবিতার আগে কিম্বা শেষে কবির কোনও নাম ছিল না। শুধু ‘শ্রী’ উল্লেখ ছিল। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, এটি ছাপার ভুল নয়। কবি নিজের নাম দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলেই এমন করে লেখা হয়েছিল।
তাঁর একনিষ্ঠ অনুসন্ধানে একই বর্ষের শেষ সংখ্যাটি অর্থাৎ চৈত্র সংখ্যাটি তিনি উদ্ধার করেন। যে সংখ্যাটিতে ব্রহ্মবাদী পত্রিকার সারা বছরের লেখা ও লেখক-লেখিকাদের বাৎসরিক সূচী ছাপা হয়েছিল।সেখানে বর্ষা আবাহন কবিতার কবির নাম কিন্তু উহ্য রাখা হয় নি।খুব স্পষ্টভাবেই সেখানে লেখা ছিল ওই কবিতার কবি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাস, বি.এ।
‘বর্ষা-আবাহন’ কবিতাটিই কি ছাপার হরফে জীবনানন্দের প্রথম কবিতা? জীবনানন্দের প্রথম দিকের প্রায় সব কবিতাই প্রকাশিত হয়েছিল বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায়। এই পত্রিকার সঙ্গে তাঁর পরিবার এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজনেরা বেশ ভালভাবেই যুক্ত ছিল।
যতদূর জনা যায় ‘ব্রহ্মবাদী’পত্রিকার জন্ম বাংলা ১৩০৭, ইংরেজি ১৯০১ সালে। তার মানে জীবনানন্দের দাশের জন্মের দু’বছর পরে ওই পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে। সেই সময়ে বরিশালে ব্রাহ্মদের কথা প্রচারের উদ্দেশেই যে ওই পত্রিকা তা বলাই বাহুল্য। পত্রিকার আলোচ্য বিষয় ছিল ব্রাহ্মধর্ম, নীতি, শিক্ষা, সমাজতত্ত্ব।
এই পত্রিকার একেবারে গোঁড়ার দিকে সম্পাদক ছিলেন জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাসগুপ্ত। পরে অবশ্য তিনি ওই দায়িত্বে ছিলেন না। তবে ‘ব্রহ্মবাদী’পত্রিকা ছিল জীবনানন্দ দাশের পারিবারিক পত্রিকা। তাঁর মা কুসুমকুমারী দেবীও এখানে কবিতা লিখতেন। বাবা সত্যানন্দও লিখতেন। জীবনানন্দ দাশের বর্ণনা থেকেই জানা যায় যে, পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন তাঁর পিসেমশায় আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী। তাঁর পিসেমশায় তাঁদের বাড়িতে এসে তাঁর মাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিয়ে যেতেন।
‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকাতেই যে জীবনানন্দের কবি প্রতিভার প্রথম প্রকাশ ঘটে, এটা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না। পরবর্তীতে একাধিক জীবনানন্দ গবেষক এমনকি কবির নিজের লেখা থেকেও সে কথা স্পষ্ট হয়।জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ কবির একেবারে কৈশোরের একটা কবিতার দুটি পংতি একবার স্মরণ করেছিলেন-‘এল বুঝি বৃষ্টি এল / পায়রাগুলো উড়ে যায় কার্নিশের দিকে এলোমেলো’।
এটাই যে ছাপার হরফে জীবনানন্দের প্রথম কবিতা সেটা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় খুব জোর দিয়ে বলেন নি। তবে কবিতায় কেন জীবনানন্দের নাম ছিল না, সে বিষয়ে তিনি তাঁর ‘জীবনানন্দ: জীবন ও কবিতার আলোচনা’বইতে লিখেছেন,‘বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় জীবনানন্দের যে সব প্রকাশিত কবিতা দেখা যায়, তাঁর মধ্যে এই কবিতাটিকেই এখনও তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলেই মনে হয়। খুব সম্ভব জীবনানন্দ স্বেচ্ছায় ব্রহ্মবাদী-তে এই কবিতাটি লেখেননি,কারও অনুরোধ বা নির্দেশেই এই কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন। তাই নিজের নাম কবিতার সঙ্গে প্রকাশ করতে দেননি। এই নাম প্রকাশে তাঁর সংকোচ সম্বন্ধে আমার মনে হয়, যেহেতু ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মদের পত্রিকা এবং জীবনানন্দ নিজে ব্রাহ্ম হলেও ব্রাহ্মদের আচার অনুষ্ঠান, এমন কি সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানই এড়িয়ে চলতে ভালবাসতেন; সেই জন্যই হয়ত ঐ পত্রিকায় নাম প্রকাশ করতে চাননি’।
2 Comments
জীবনানন্দ দাশকে কি ‘ নিয়তি-তাড়িত ‘ কবি বললে অত্যুক্তি হবে ?
বার বার যেন জীবনের কাছে হেরে যাওয়া মানুষ..
অথচ শিক্ষিত ( ইংরেজি সাহিত্যে এমএ), ব্যতিক্রমী প্রতিভাধর এক কবি !
কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল বরিশাল থেকে প্রকাশিত ব্রাক্ষবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় ১৯১৯ সালে। কবিতাটিতে কবির নাম ছাপা হয়নি । কেবল সম্মানসূচক শ্রী কথাটি লেখা ছিল । তবে পত্রিকার বর্ষশেষের নির্ঘন্ট সূচিতে তার পূর্ণ নাম ছাপা হয় ।