আর পাঁচটা শহরে বাস-ট্যাক্সি বা ব্যক্তিগত গাড়ি যেভাবে চলে, এ শহরে প্লেনও চলে সেভাবে। গাড়ির গ্যারাজের মতোই প্লেন রাখার হ্যাঙ্গার রয়েছে ঘরে ঘরে! এ এমন এক শহর যেখানে অলিগলি, ছোট-বড় রাস্তা বলে কিছুই নেই। একটাই পথ- তার পুরোটাই রানওয়ে।শহরকে দু’ভাগে ভাগ করে সেই রানওয়ে এসে মিশেছে যে রাস্তায় সেই পথটিও ১০০ ফুট প্রশস্ত। বিমান অনায়াসে ওঠানামা করতে পারে সেখানেও। এমনকি ব্যস্ত রাস্তায় চলন্ত গাড়িকে পাশ কাটিয়ে এগিয়েও যেতে পারে বিনা বাধায়।রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডগুলো তৈরী করা হয়েছে নিচু করে। প্লেনের ডানা লেগে নষ্ট না হয়ে যায়, তার জন্যই অতিরিক্ত সাবধানতা। এমনকি রাস্তার নামও ‘বোয়িং রোড’।
শহরের নাম ক্যামেরন পার্ক। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার এই শহরে যারা থাকেন, তারা অফিস যান প্লেনে চড়ে! এমনকি সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতেও বেড়িয়ে পড়েন প্লেন নিয়েই। সরকারি নথিতে অবশ্য ক্যামেরন পার্ক শহর নয়। আদতে একটি ফ্লাই-ইন রেসিডেন্সিয়াল কমিউনিটি। এই ধরনের কমিউনিটি মূলত বিমানপোতে গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার বহু বিমানপোত অকেজো হয়ে পড়েছিল। একইসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত পাইলটের সংখ্যাও বাড়ছিল। সংখ্যাটি ১৯৩৯ সালে ৩৪ হাজার থেকে বেড়ে ১৯৪৬-এ চার লাখে গিয়ে ঠেকে। যুদ্ধে অংশ নেওয়া অবসরপ্রাপ্ত পাইলটদের আরামের অবসর দিতেই ফ্লাই-ইন রেসিডেন্সিয়াল কমিউনিটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমেরিকার অসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ ঠিক করে অকেজো বিমানপোতগুলোতেই অবসরপ্রাপ্ত বিমানচালকদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। চেনা পরিচিত পরিবেশে থাকতে পাইলটদের ভাল লাগবে, এই ধারণা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
১৯৬৩ সালে সেই ভাবনা থেকেই তৈরি ক্যামেরন পার্ক। একসময় নাম ছিল ক্যামেরন পার্ক এয়ারপোর্ট। সেই নাম বদলে হয় ক্যামেরন পার্ক এয়ারপার্ক। শহরের প্রতিটি পরিবারেরই কোনও না কোনও সদস্য একসময় পাইলট বা বিমানচালক ছিলেন। বিশ্বে এমন ফ্লাই-ইন কমিউনিটি রয়েছে ৬৪০টি। তার মধ্যে ৬১০টিই আমেরিকায়। তবে বৈশিষ্ট্যে ক্যামেরন পার্ক সবচেয়ে নিখুঁত বলে মনে করা হয়। পুরনো আমলের ঐতিহ্যবাহী গাড়ির প্রদর্শনীর প্রচলন আছে বিশ্বের বহু শহরে। ক্যামেরন পার্কে গাড়ির পাশাপাশি প্লেনেরও প্রদর্শনী হয়। বছরে এক দিন রানওয়ে বরাবর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে বিভিন্ন মডেলের বিমান। রানওয়ে ধরে একসঙ্গে সেই সব বিমানের উড্ডয়নের দৃশ্যও দেখার মতো।
হাতে গোনা ১২৪টি বাড়ি রয়েছে এই শহরে। তার মধ্যে ২০টি বাড়ি ফাঁকা পড়ে রয়েছে। সেই সব বাড়ি সস্তায় বেঁচেও দিচ্ছেন মালিকরা। ফেব্রুয়ারি মাসেই এমন একটি বাড়ির বিজ্ঞাপন প্রকাশ্যে আসে। ইন্টারনেটে দেওয়া সেই বিজ্ঞাপনে প্লেনের হ্যাঙ্গার সহ বাড়িটির দাম চাওয়া হয়েছিল মাত্র ৬ লাখ ৮৫ হাজার ডলার! তবে ক্যামেরন পার্কের অধিকাংশ বাসিন্দা আরামেই আছেন। ছোট্ট ‘শহর’ এ সুবিধার কমতি নেই। স্কুল, বাজার, হাসপাতাল, এমনকি শপিংমলও রয়েছে। আর যদি কিছু না পাওয়া যায় তা হলেই বা চিন্তা কীসের! প্লেনে চড়ে কাছের শহরে চলে যাওয়া তো মিনিট কয়েকের ব্যাপার মাত্র!
আরও একটা মজার ব্যাপার হলো এই গ্রামের রাস্তার নামগুলো বিমান চালনার সাথে সম্পর্কিত, যেমন বোয়িং রোড, সেসনা ড্রাইভ এব আরও অনেক কিছু। ক্যামেরন এয়ারপার্কে বিমানে যাওয়া তেমন বড় কিছু নয়। এটি একটি গাড়ী চালানোর মত কাজ। প্রতিটি বাড়িই হ্যাঙ্গার দিয়ে তৈরি করা হয়। তাদের বাড়ির ভিতরে গ্যারেজের মতো বা বাড়ির সংস্পর্শে বাইরে এই হ্যাঙ্গার তৈরি করা হয়। প্লেন থাকা বাসিন্দাদের কাজের জন্য বাইরে যাওয়ার সময় গেট খোলার জন্য রিমোট ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যারেজের গেটগুলো বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তৈরি করা হয়। ক্যামেরন পার্কের মতো ফ্লোরিডার স্প্রুস ক্রিক এয়ার-পার্ক প্রায় ৬৫০ টি বিমান নিয়ে গর্ব করে যার মধ্যে ব্যক্তিগত জেট থেকে ঐতিহাসিক বিমান পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এ ধরনের আবাসিক এলাকায় বসবাসকারীদেরকে ফ্লাই-ইন সম্প্রদায় বলা হয়ে থাকে। ফ্লোরিডার স্প্রুস ক্রিক এ প্রায় ৫ হাজার জন বাসিন্দা, ১৩শ টি বাড়ি এবং ৭০০টি হ্যাঙ্গার নিয়ে গঠিত যা একটি ব্যক্তিগত এয়ারফিল্ডকে কেন্দ্র করে ঐ গ্রামের বাসিন্দারা আশ্চর্যজনকভাবে একটি ব্যতিক্রমী জীবন উপভোগ করে। ক্যামেরন এয়ারপার্কের মতো এয়ারপার্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরও অনেক রয়েছে; সংখ্যায়, আপনি ৪২৬ টি আবাসিক এয়ারপার্ক দেখতে পারেন। এটিও অনুমান করা হয় যে ফ্লোরিডায় ৫২ টি এয়ারপার্ক, ওয়াশিংটনে ৫০টি, ক্যালিফোর্নিয়ায় ২৮টি এবং ওরেগনে ২৩ টি এয়ারপার্ক রয়েছে.