কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান বলে শ্বেতাঙ্গ সমাজে তাঁর ঠাঁই হয়নি। অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ বাবার সন্তান বলে। জন্মের পর থেকেই তাই বর্ণবিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছিল তাকে। গায়ের রঙ তামাটে হওয়ার জন্য কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত স্কুলে সহপাঠীরা তাকে খেপাত সাদা বালক বলে। ছেলেবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি ইংল্যান্ডে থাকা বাবার পরিবারের কাছে স্বীকৃতির জন্য জন্য গিয়েছিলেন কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান হওয়ার অপরাধে তাঁকে নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল শ্বেতাঙ্গ পরিবার। সেদিন থেকেই বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করার জেদ তাঁকে পেয়ে বসেছিল।
আঠারোর সদ্য যুবক ছেলেবেলার বন্ধুদের নিয়ে ‘টিনেজারস’ নামক একটি গানের দল তৈরি করেন। পরে তাঁরা সেই দলের নাম বদলে ‘ওয়েইলিং রুড বয়েজ’ করেন। এই দলটি বিখ্যাত মিউজিক প্রোমোটর কক্সন ডডের নজর কেড়েছিল। তিনিই বব মার্লে ও নাম পরিবর্তীত ব্যান্ড ‘দ্য ওয়েলারস’কে বিশ্বের সামনে নিয়ে আসেন।সঙ্গীত জগতে তুফান তুললেন বব মার্লে ও তাঁর ব্যান্ড ‘দ্য ওয়েলারস। গেল শতকের ৭০ এর দশকে বব মার্লে তার নান্দনিক সুরের মূর্ছনায় শ্রোতা-দর্শকদের মাতিয়ে দিলেন। তিনি নিজেই লিখলেন গান, সুর করলেন এবং গাইলেন। মার্লে নতুন করে জ্যামাইকান সঙ্গীতকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছালেন। রেগি, স্কা, রক স্টেডি সহ নানা ধরনের সঙ্গীত মিলেমিশে একাকার হল মার্লের গানে। সেই সুরের তালে শ্রোতারা যেন ভুলে গেলেন তাদের দুঃখ-কষ্ট, মেতে উঠলেন তালে, নেচে উঠলেন ছন্দে। বব মার্লের ‘সিমার ডাউন’ অ্যালবামটি সত্তর হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল।
এরপর ‘দ্য ওয়েলারস’ ভেঙেছে একাধিকবার। কিন্তু থেমে থাকেন নি মার্লে বরং তার গান আরও বিদ্রোহী হয়েছে, প্রতিবাদের স্বর আরও তীব্র হয়েছে। আসলে বব মার্লের গান মানেই বর্ণবৈষ্যম্যের বিরুদ্ধে বারুদঠাসা গোলা। গানকেই তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, লিঙ্গ বৈষ্যম্যের বিরুদ্ধে, ক্ষমতাবান উন্নত দুনিয়ার বিরুদ্ধে, অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা করেছিলেন। নিজের লেখা ও সুর করা গানকে হাতিয়ার করে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। বব মার্লের ‘বার্নিন’ অ্যালবামটি বিশ্বের অনেকগুলি দেশে দেশে ঝড় তুলেছিল। এই অ্যালবামেই তিনি গেয়েছিলেন দুনিয়া কাঁপানো ‘গেট আপ, স্ট্যান্ড আপ ফর ইয়োর রাইটস’ গানটি।পরবর্তীতে এই গানটি বিভিন্ন দেশে বর্ণবিদ্বেষ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে গিয়েছিল। এই গানেই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, “কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো গেলেও, সব মানুষকে চিরকালের জন্য বোকা বানানো যাবে না। আমরা নিজেরা যদি নিজেদের জীবনের মুল্য বুঝতে পারি তাহলে আশার আলো নিজেরাই দেখতে পাব। জাগো, উঠে দাঁড়াও তোমার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।
তাঁর গান ছিল অন্ধকারে ফেলে রাখা মানুষদের কাছে আশার প্রদীপ। ‘নো ওম্যান, নো ক্রাই’ গানে বব মার্লে বলেছিলেন, “না নারী, তুমি কেঁদো না। তোমার অশ্রু শুকিয়ে নাও, সুদিন আসছে।” ‘ব্ল্যাক প্রগ্রেস’ গানে মার্লে বলেছিলেন, “অধিকারের ভাগ না পেলে লড়াই থামাব না”। দুনিয়ার যেখানেই প্রতিবাদ, আন্দোলন, যেখানে শোষণের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়েছে, সেখানেই বব মার্লের গান তুফান তুলেছে। তাঁর গান যুগ যুগ ধরে অত্যাচারিত মানুষের মনে বিদ্রোহের বীজ বপন করে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে হয়তো তাই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে বব মার্লের মৃত্যু জরুরী হয়ে উঠেছিল! লন্ডনে বব মার্লেকে একবার গাঁজা রাখার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং সাজা দেওয়া হয়েছিল। মার্লে লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে কাটান দু’বছর।
তাঁকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে। আততায়ীরা তাঁকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল, গুরুতর আহত হয়েছিলেন ব্যান্ডের ম্যানেজার, কর্মচারী, মার্লের স্ত্রী এবং বব মার্লেও। এর দু’দিন পর, আশি হাজার দর্শকের সামনে একা বব মার্লে গুলির ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে অকুতোভয় ‘গেট আপ, স্ট্যান্ড আপ ফর ইয়োর রাইটস’ গেয়ে আবেগে ভেসেছিলেন শ্রোতাদের। মার্লে বলেছিলেন, “যারা এই পৃথিবীকে কলুষিত করতে তাদের কাজ একদিনের জন্যেও বন্ধ করে না, তাহলে আমি কেন আমার গান থামাবো”। ইতিমধ্যেই তিনি আফ্রিকার কয়েকটি অঞ্চলের প্রচলিত সহজিয়া ধর্ম রাস্তাফারি বিশ্বাসের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রাস্তাফারিজমকেই ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন। এসময় রাস্তাফারি বিশ্বাস অনুযায়ী তাঁর চুল লম্বা জটাযুক্ত করেন। তাঁর প্যান আফ্রিকানিজম, রাজনৈতিক প্রগতিশীলতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জীবনাচরণ সবই ছিল তার হৃদয়ের গভীরে ধারণ করা রাস্তাফারিয়ান বিশ্বাসের থেকে। রাস্তাফারিয়ান থেকেই তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকম গাঁজায় আসক্ত। তবে ফুটবল ছিল মার্লের ভালবাসা।