কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-বয়স নির্বিশেষে তার প্রতি প্রেমের শেষ নেই।উত্তর ভারতে তার নাম “গোল-গাপ্পা”, মহারাষ্ট্রে “পানিপুরি”, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশে ‘পাতাসি’, তেলেঙ্গানা-উড়িষ্যা-ছত্তিশগড়-হায়দ্রাবাদে ‘গুপচপ’, নেপাল-শ্রীলঙ্কায় ‘ফুলকি’, দক্ষিণ এশিয়ায় ‘কুজিন’। প্রাচীন ভারতের গঙ্গার তীরে মগধ রাজ্যে যখন ফুচকা তৈরি হয়েছিল, তখন এর নাম ছিল ‘ফুলকা’। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক জার্নাল অব্ ইণ্ডিয়ায় ফুচকার উৎপত্তিস্থল বলা হয়েছে বারাণসী। ইতিহাস ও উপকথাজুড়ে রয়েছে ফুচকার নাম। প্রাচীন গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের লেখা ‘ইন্ডিকা’তেও চালের তৈরি ফুচকার হদিস মেলে। তার মানে ফুচকা খাওয়ার চল ছিল ২ হাজার বছর আগেও। তবে ফুচকার উৎপত্তি নিয়ে মহাভারত অনুযায়ী দ্রৌপদীই প্রথম পঞ্চপাণ্ডবকে ফুচকা খাইয়েছিলেন।
পাণ্ডবদের বনবাস কালে রান্নার উপকরণ ছিল একেবারেই সীমিত। পাণ্ডবমাতা কুন্তি একদিন আগের দিনের বেঁচে যাওয়া সামান্য কিছু আলুসবজি ও ময়দা মাখা দ্রৌপদীকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, সবাই যেন পেট ভরে খেতে পায়! দ্রৌপদীর রান্নার হাত ছিল বেশ পাকা। তাই তিনি ওইটুকু উপকরণে ঘাবড়ালেন না। বুদ্ধি করে ময়দার ময়ামকে সমানভাগে ভাগ করলেন। তার ভেতর পুরে দিলেন সেই বাসি আলুসবজি। এরপর উনুনের উপর কড়াই বসিয়ে তেল ঢাললেন। এরপর গোল গোল করে রাখা পুর ভরা ময়দার লেচিগুলিকে ছেড়ে দিলেন গরম ডুবো তেলে।ধীরে ধীরে সেই লেচিগুলি ফুলে উঠতে শুরু করলে দ্রৌপদী সেগুলি কড়াই থেকে নামিয়ে নিলেন তারপর সবাইকে সমানভাগে পরিবেশন করলেন। আলুসবজির পুর দিয়ে ডুবোতেলে ভাজা মচমচে এই খাবারটি কুন্তী এবং পাঁচ ভাইয়েরই দারুণ পছন্দ হল। কুন্তি পাঁচ পুত্রবধূর রান্নায় খুশি হয়ে বর দিলেন এই খাবার অমরত্ব লাভ করবে। নতুন স্বাদের এই খাবারটিই আজকের ফুচকার আদিরূপ! মহাভারতে ফুচকাকে ‘জলপত্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফুচকার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে মহাভারতের এই কাহিনী লোকমুখে বেশ প্রচলিত। এছাড়া ৩১০ খ্রিষ্টপূর্বে মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’র পাতায় দু’হাজার বছর আগেও যে ‘ফুলকা’র লেখা হয়েছিল সেটিও মহাভারতেরই সমসাময়িক। তবে বইটি এখন বিলুপ্ত। আবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক্যাল জার্নাল অভ ইন্ডিয়ার ১৯৫৫ সালের সংখ্যার ১১৬ নাম্বার পৃষ্ঠায় ফুচকা নিয়ে যে বিশদ বিবরণ রয়েছে, সেখানে এই খাবারের উৎপত্তিস্থল বলা হয়েছে বারাণসী। ওই লেখায় ফুচকাকে লুচির ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা হয়েছে, তবে তা লুচির চেয়ে শক্ত এবং কুড়মুড়ে। পরবর্তীকালে ফুচকা মোগলাই খানার সংস্পর্শে আসার পর ভারতীয়রা ফুচকার আকার বা আঙ্গিকে পরিবর্তন আনে। শক্ত কুড়মুড়ে লুচির সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন মসলাপাতি সঙ্গে টক-মিষ্টি পানীয়।
ফুচকার দুটি অপরিহার্য উপাদান আলু এবং মরিচ, এই দুটি উপাদান ৩০০–৪০০ বছর আগে ইউরোপীয়ানদের হাত ধরে ভারতে এসেছিল। ফুচকা প্রথম দিকে ফুলকি নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীনকালের সেই ফুলকি দেখতেও অনেকটা ছোটো এবং কুড়মুড়ে ছিল। অঞ্চলভেদে কেবল নামকরণ নয়, পরিবেশনের পদ্ধতিতেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। দিল্লি, জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশে এর নাম গোলগাপ্পা। দেখতে লম্বাটে ধরনের এই খাবারে দেওয়া হয় আলু, মটর, টক-মিষ্টি চাটনি। গোলগাপ্পা বা ফুচকা পরিবেশন করা হয় টক জলে ডুবিয়ে, যাতে থাকে মশলা আর পুদিনা পাতার সমাহার। গুজরাটে বলা হয় পাকোড়ি, যা স্বাদে এবং পরিবেশনে ফুচকার মতোই। শুধু বৈচিত্র্য আনতে দেওয়া হয় ঝুরিভাজা আর পুদিনা, কাঁচা মরিচ, তেঁতুলের টক-ঝাল মেশানো জল।
ফুচকার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত নাম হলো পানিপুরি। মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর বিভিন্ন জায়গায় পানিপুরিতে তেঁতুলের মিষ্টি চাটনিতে ডোবানো থাকে ঝাল মটরের তৈরি রাগড়া। তবে মধ্যপ্রদেশের কিছু জায়গার পানিপুরিতে থাকে আলু সেদ্ধ ঝাল করে মাখা এবং মিষ্টি চাটনি। মধ্যপ্রদেশ, মুম্বাই, পুনের আকর্ষণীয় এক পদ সেভপুরি। সেভ হল ভুজিয়া। অনেক জায়গাতে সেভ দিয়ে ফুচকা তৈরি হয়। মুম্বাইয়ের উৎপত্তি হলেও আজ অনেক জায়গায়ই এটি জনপ্রিয়। সঙ্গে থাকে রসুনকুচি। রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশে ফুচকা পাতাসি নামে পরিচিত খাবারটি অনেকটা গোল্গাপ্পার মতোই। তবে তেঁতুল জলের পরিবর্তে শুকনো আমের চাটনি ব্যবহার করা হয় এখানে। এছাড়া তেলেঙ্গানা, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, হায়দরাবাদের অনেক জায়গায় ফুচকাকে গুপচুপ বলা হয়। এখানে আলু ব্যবহার করা হয়না, তার পরিবর্তে ছোলা বা মটর সেদ্ধ, আর থাকে তেঁতুলের টক-ঝাল-মিষ্টি ঝোল।