জলকে কেন্দ্র করেই মূলত মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন সভ্যতাগুলির বেশিরভাগই গড়ে উঠেছিল নদী অথবা সমুদ্র তীরে। অথচ এই জলই আবার গিলে নিয়েছে প্রাচীন অনেক শহর, বন্দর। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ২০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে সমুদ্রে ডুবে থাকা এক শহরের নাম হেরাক্লিয়ন। শহরটি থনিস নামেও পরিচিত। খৃষ্টপূর্ব ১২শ বছরেরও আগে অর্থাৎ প্রায় ৩২০০ বছর আগে এই শহরের অস্তিত্ব ছিল। যদিও তখন শহরটি জলের নীচে ছিল না, ডাঙাতেই ছিল। পরে সমুদ্র এটিকে গ্রাস করে নেয়। সেও প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা।
হেরাক্লিয়ন, প্রাচীন মিশরের এক বিলুপ্ত শহর। গ্রিক পুরাণকার তথা ঐতিহাসিকদের মতে, হেরাক্লিয়ন ছিল ভূমধ্যসাগরের পাদদেশে অবস্থিত প্রাচীন মিশরের অন্যতম প্রধান বন্দর-নগরী। নীল নদের বদ্বীপ অঞ্চলে বর্তমান আলেকজান্দ্রিয়া নগরের ৩২ কিলোমিটার (২০ মাইল) উত্তরপূর্বে ছিল এই প্রাচীন বন্দর। জলেঘেরা সেই শহরের ঠিক নীচ দিয়েই বয়ে গেছে ভূমধ্যসাগর। সুদূর অতীতে মূলত গ্রিস ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের জন্য ব্যবহৃত হত এই বন্দর। প্রাচীন মিশরীয়রা এই শহরকে ‘থনিস’ অথবা ‘তাহোনে’ বলে অভিহিত করত। গ্রিক শব্দ তাহোনের অর্থ হল সমুদ্রের প্রবেশদ্বার। সুদূর অতীতে খুবই সমৃদ্ধশালী বন্দর ছিল এই হেরাক্লিয়ন। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন হেরাক্লিয়নের সুখ সমৃদ্ধির পেছনে আছে বন্যা ও শস্যফলনের দেবতা হাপির আশীর্বাদ।
সাগর জলে হারিয়ে যাওয়া এই নগরীর কথা লিখে গিয়েছেন অনেক ইতিহাসবিদ। বিশেষ করে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরাডোটাস, ডাইয়োডোরাস এবং স্ট্রাবোর লেখায় শহরটির উল্লেখ আছে। হেরোডোটাসের বর্ণনা অনুসারে ট্রয়ের রানী হেলেন তার বন্ধু প্যারিসের সঙ্গে হেরাক্লেয়নে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন। তবে ইতিহাসের সূত্র ধরে শহরটিকে খুঁজে বের করার খুব যে তাগিদ ছিল, এমন নয়। ২০০১ সালে রণতরী খুঁজতে এসে আলেক্সান্দ্রিয়ার কাছে সমুদ্রের নীচে কিছু গুপ্তধন, ভাস্কর্যের ভাঙ্গা অংশের খোঁজ পান ফরাসি প্রশ্নতাত্ত্বিক দলটি। সেই সূত্র ধরে পরে খুঁজে পাওয়া যায় শহরের আরও অনেক নিদর্শন। প্রথমে সমুদ্রের নীচে পলিমাটি চাপা পড়ে থাকা পাথরের বিশাল সব ভাস্কর্যের ধ্বংসাবশেষ সমুদ্রতীরে তুলে আনা হয়। প্রথম আবিষ্কারের ১২ বছর পর মানুষের সামনে উন্মোচিত হয় হেরাক্লেয়নের অমুল্য সব নিদর্শন। সেই সব নির্দশনের মধ্যে আছে মিশরীয় দেবী আইসিস, দেবতা হাপি এবং নাম না জানা এক ফারাও এর মূর্তি।
কাদার নিচে চাপা পড়ে থাকলেও অনেক মূর্তি মোটামুটি অক্ষত ছিল। পানির নিচ থেকে উদ্ধার করা গেছে ১৬টি বিশাল আকৃতির মূর্তি। এছাড়া আরও পাওয়া গেছে মিশরের অন্যান্য দেব-দেবীর ছোট আকৃতির শত শত মূর্তি। এই মূর্তিগুলো ছিলো আমুন-গেরেব একটি মন্দিরে।আর এ মন্দিরে নীলনদের রাণী হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ক্লিওপেট্রা। এই আমুন-গেরেব মন্দিরের অনেকগুলো শবাধার পাওয়া গেছে, যাদের মাঝে ছিলো বলি দেওয়া বিভিন্ন প্রাণীর মমি করা দেহ। এদেরকে উৎসর্গ করা হয়েছিলো মিশরের সবচাইতে উচ্চ পর্যায়ের দেবতা আমুন-গেরেব এর উদ্দেশ্যে । ধর্মীয় প্রতীক সম্বলিত অনেক অ্যামিউলেট বা অলংকারও পাওয়া যায় যাতে আইসিস, ওসিরিস এবং হোরাসের মতো দেব-দেবীর প্রতিকৃতি দেখা যায়। এসব অ্যামিউলেট শুধুমাত্র ওই এলাকার অধিবাসীদের জন্য নয় বরং সেখানে আসা দর্শনার্থী এবং ব্যাবসায়িদের জন্যেও তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে ।
শুধু ধর্মীয় নিদর্শন নয়, হেরাক্লেয়নে পাওয়া গেছে ৬৪ টি জাহাজের ধ্বংসস্তূপ । যে কোনও এক স্থানে এতগুলো জাহাজ পাওয়ার নমুনা এই প্রথম। এ ছাড়াও পাওয়া যায় ৭০০টি নোঙর । প্রাচীন পৃথিবীর অর্থনীতির জন্যেও হেরাক্লিয়ন ছিলো গুরুত্বপূর্ণ । এখানে পাওয়া গেছে স্বর্ণ এবং সীসার মুদ্রা এবং এথেন্স থেকে আসা বাটখারা। কন্সট্যান্টিনোপল, রোম এবং এথেন্স সহ বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করার জন্য তখন ভূমধ্যসাগর ব্যবহৃত হতো এবং গবেষকরা ধারণা করছেন সেখানকার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী ছিলো হেরাক্লেয়ন। আর যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রাকৃতিক জলপথের পাশাপাশি এখানে একটি কৃত্রিম খালও কাটা হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।
হেরাক্লেয়নের এই আবিষ্কার অতীতের অনেক রহস্য সমাধানে ভুমিকা রাখবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। তার কারণ হলো এখানে পাওয়া গেছে এমন সব নিদর্শন যা খুবই ভালো অবস্থায় সংরক্ষিত ছিলো। পাওয়া গিয়েছে অক্ষত সব স্লেটের পুঁথি। এমনি এক স্লেটের টুকরো থেকে এক সময়ে হায়ারোগ্লিফের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো। হেরাক্লেয়ন থেকেও অনেক রহস্যের সমাধান পাওয়া যাবে বলে গবেষকদের আশা।