নাগাল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত মন জেলার উত্তরে অরুণাচল প্রদেশ, পশ্চিমে অসম, পূর্বে মায়ানমার ও দক্ষিণে নাগাল্যান্ডের লংলেং ও টুয়েনসাং জেলা৷ জেলার প্রশাসনিক সদরের নাম মন৷ এই জেলার উত্তর পূর্ব কোণায় লঙ্গয়া গ্রাম।২০১১-র জনগণনা অনুসারে মন জেলার মোট জনসংখ্যা আড়াই লক্ষের একটু বেশি।এখানে জুম চাষ চালু রয়েছে। জুম চাষের জন্য জমির অবক্ষয় হয় এবং পরিবেশ দূষিত হয়। এই পদ্ধতিতে চাষ মোটেও লাভজনক নয়। অনেক চেষ্টা করে দেশের অন্যত্র জুম চাষ বন্ধ করা গেলেও মন জেলায় এখনও বিক্ষিপ্ত ভাবে এই প্রথা চালু রয়েছে। ফলে এখানকার অনেককেই বাড়তি উপার্জনের আশায় প্রতিবেশী জেলা ও অন্য রাজ্যে ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যেতে হয়।অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিরিখে বলার মতো তেমন কিছুই নেই। তবুও লঙ্গয়া গ্রামের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য অনবদ্য।

রাজ্যের উত্তরতম অংশে অবস্থিত মন জেলার লঙ্গয়া গ্রাম নিয়ে বলার কথা হল যে এর মধ্য দিয়ে ভারত আর মায়ানমার সীমান্তরেখা চলে গিয়েছে।লঙ্গয়া কোনিয়াক জনজাতিদের গ্রাম। এই গ্রামের অধিকাংশ বাড়ির এক অংশ ভারতে অবস্থিত। বাকিটার ঠিকানা মায়ানমার। কোনও বাড়ির রান্না হয় ভারতে আর খাওয়ার জন্য মায়ানমারে যেতে হয়। কারণ খাওয়ার ঘরটি ভারতের মাটির মধ্যে পড়েনি। তবে রান্নাঘর থেকে খাওয়ার ঘরে যাওয়ার জন্য কোনও পাসপোর্ট ভিসার দরকার লাগেনা। আসলে সরেজমিনে সমীক্ষা না করে মানচিত্রের উপর খেয়ালখুশি কলম-পেন্সিলের আঁচড় কেটে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ করলে এমনটাই হয়। ভারতে থাকা লঙ্গয়া গ্রাম নাগাল্যান্ডের ফোমচিং বিধানসভার অন্তর্গত। অন্যদিকে মায়ানমারের অংশটি সেদেশের ইওচেন লে শহরের আওতায়। আন্তর্জাতিক সীমানা গ্রামকে দু’ টুকরো করলেও এখানকার বাসিন্দারা তথা কোনিয়াক জনজাতির মানুষের কিন্তু সীমান্তের দু প্রান্তেই অবাধে যাতায়াত করে। এমনকি মায়ানমারের ২৭টি গ্রামে কোনিয়াক জনজাতির মানুষও বাস করে।

বয়স্ক কোনিয়াক পুরুষের কানে থাকে হাড়ের তৈরি বড় দুল, পরনে কেবল একটি কটিযুক্ত পোশাক। কেউ কেউ ‘দাও’ বা ‘বন্দুক’ নামের একটি অস্ত্র বহন করেন। মেয়েদের পিঠে বাঁধা বাঁশের ঝুড়িতে বাচ্চাদের কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। পরম্পরাগতভাবে কোনিয়াকরা সারা শরীরে উল্কি আঁকিয়ে থাকেন। কোনিয়াকদের হাতে বোনা শালের নকশা নজর কাড়তে বাধ্য। উৎসব চলাকালীন পুরুষরা পালকে সজ্জিত রঙিন শাল এবং শিরোস্ত্রাণ পরিধান করে হাতে দাও-বর্শা-বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন। নাচের সঙ্গে চলতে থাকে ছন্দবদ্ধ গান। কোনিয়াকদের প্রধান উৎসব ‘আওলেয়াং মনয়ু’ উদ্যাপন করা হয় প্রতি বছর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে৷ একটা সময় পর্যন্ত শত্রুর শিরশ্ছেদ ছিল কোনিয়াক জনজাতির জনপ্রিয় বিনোদন। জমি দখলের জন্য আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের উপর আক্রমণ চালানো হত। কোনিয়াকদের দাপটে রীতিমতো সন্ত্রস্ত থাকত প্রতিবেশী জনজাতির সমস্ত মানুষ। কোনিয়াকদের বাড়ি সাধারণত পাহাড়ের উপর তৈরি করা হত যাতে সহজেই শত্রুদের উপর নজর রাখা যায়। শত্রুর শিরশ্ছেদের পর তার মাথার খুলি সংগ্রহ করা হত। তখনকার রীতি ছিল যাঁর সংগ্রহে যত বেশি নরমুণ্ড, সে তত সম্মানীয়৷ ১৯৪০-এ শিরশ্ছেদ করার প্রথা সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও অনেকের মতে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত তা চালু ছিল। গ্রামের অনেক পরিবারে এখনও পিতলের খুলির মালা দেখতে পাওয়া যায়।

লঙ্গয়া গ্রামে রয়েছে অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চারদিকে সবুজের সমারোহ। লঙ্গয়া এলাকায় দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে ডোয়াং নদী, শিলোই লেক। কোনো বাড়ির দেওয়ালে ফ্রেস্কো এবং কুলুঙ্গিতে পুরনো মূর্তি। কিছু বাড়ি অপরূপ নাগা-শৈলীর খড়ের ছাদবিশিষ্ট।আশপাশের এলাকায় রয়েছে সাংন্যু গ্রাম। এখানে আছে ৮ ফুট উচ্চতার ও ১২ ফুট প্রস্থের একটি ঐতিহাসিক কাঠের মূর্তি৷ মূর্তিটিতে মানুষ ও জীব-জন্তুর প্রতিচ্ছবি খোদাই করা আছে৷ ইতিহাস মতে, এই গ্রামের ও আহোম রাজত্বের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল৷ সদর শহর মনের কাছের এক গ্রামের নাম চুই। গ্রামটির আং-এর বিরাট বাড়িটির সম্মুখভাগ পূর্বপুরুষ ও তাঁর নিজের হাতে নিধন করা শত্রুর কঙ্কালে সজ্জিত৷ আর রয়েছে নাগনিমুরা নামের এক জনপদ। নাগা রানিদের সমাধিস্থল বলে এমন নামকরণ। এখানকার মানুষ প্রচুর আফিম খায়। তবে এই আফিম গ্রামে চাষ করা হয় না। এই আফিম মায়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হয়। বহু বৈচিত্র্যের কেন্দ্রস্থল ভারতীয় উপমহাদেশ। আশ্চর্য সব গল্প ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রান্তে। সীমারেখা দিয়ে যে তার মধ্যে পার্থক্য গড়া যায় না, লংওয়া গ্রামের গল্প তার আরেক উদাহরণ।