হিন্দুরা যে পুজোকে শক্তির আরাধনা বলেন সেই কালী পুজোর উদ্যোক্তা হলেন ধর্মে মুসলমান। মুর্শিদাবাদ জেলার সুতী এলাকার মহেন্দ্রপুর গ্রামে এমনটাই হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। এখন মহেন্দ্রপুর গ্রামে যে ৫০০০ পরিবারের বাস তারা প্রায় সবাই ধর্মে মুসলমান। এখানে মাত্র কয়েকটি হিন্দু পরিবারের দেখা মেলে। অথচ গ্রামের ঈদগাহের পাশে যে বেদী রয়েছে সেখানে প্রতি অমাবস্যায় কালীপুজো হয়। সে পুজো হিন্দুরা করলেও গ্রামের মুসলমান ধর্মের মানুষেরাই তার প্রধান উদ্যোক্তা। কেবল তাই নয়, আজ যে শক্তিদেবীর আরাধনা শুরু হয়েছে তার সমস্ত রকম আয়োজন করেছেন মহেন্দ্রপুর গ্রামের মুসলমান ধর্মী মানুষেরা। হিন্দুদের পুজো ঠিকই কিন্তু মুসলমানদের এই ধরণের উৎসাহ বা উদ্যোগ অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
মহেন্দ্রপুর গ্রামের কালি পুজোয় মুসলমান ধর্মের মানুষরাও তাদের ঘর-বাড়ি নানা রঙের আলোতে সাজান। এমনকি আতস বাজিও পোড়ান। এই গ্রামে কালী পুজোর দিন বহুকাল ধরে একটি রীতি প্রচলিত আছে। প্রতিবার কালীপুজোর রাতে মহেন্দ্রপুর গ্রামের মুসলমানেরা পাটকাঠি জ্বালিয়ে সুর করে বলে ওঠেন, ‘অশুভ যা কিছু আছে তা দূরে যাক। শুভ সব কিছু যেন ফিরে আসে।’
এখানকার কালীপুজো মুসলমান ধর্মীরা আয়োজন করলেও আশপাশের গ্রামের প্রায় সমস্ত ধর্মের মানুষরাই অংশ নেন। তাই কালীপুজোর দিন এগিয়ে আসতেই মহেন্দ্রপুর গ্রামের মুসলমান গ্রামবাসীরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন বেদী রং করতে, প্যান্ডেল বাঁধার কাজে। আশপাশের গ্রাম থেকে যারা পুজো দিতে আসবেন তাদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সে সব নিয়ে ভাবতে শুরু করেন মুসলমান গ্রামবাসীরা।
মহেন্দ্রপুর গ্রামের কালীপুজোর এই ঐতিহ্য প্রায় ৫০০ বছরের। কালীপুজোর সময় এখানে ধর্মের কোনও ভেদাভেদ থাকে না। হিন্দু, মুসলিম মিলেমিশে উৎসবে সামিল হন। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসেন। বিশেষ করে মেয়ে, জামাইরা তো আসবেনই। তাঁরা সবরকমভাবে পুজোয় অংশ নেন এবং সহযোগিতা করেন।
এই গ্রামে যে ক্লাবটি রয়েছে তার অধিকাংশ সদস্যই মুসলিম। কিন্তু তারা যেমন গ্রামের ঈদগাহ পরিস্কার পরিছন্ন রাখে্ন একই ভাবে কালীর বেদীরও যত্ন নিয়ে থাকেন। তাদের বক্তব্য অন্য কোনও ধর্মকে অসম্মান করে নিজের ধর্মকে সন্মান করা যায় না। তাই ওই বেদী হিন্দুদের হলেও দেখাশোনা করেন মুসলিমরাই।
তবে ৫০০ বছরের পুজোর কোনও প্রমান কেউ দিতে পারেন না। স্থানীয় মানুষেরা বলেন, বাপ ঠাকুরদার কাছে শুনেছেন এই এলাকায় ঘন জঙ্গল ছিল। দিনের বেলা মানুষ এখানে একা যেতে আসতে ভয় পেত। কিন্তু তখনও এই বেদী ছিল স্থানীয় মানুষের ভাষায় মায়ের থান। অনেকে একে মাঠ কালি বলত, এখনও কেউ কেউ বলে থাকে। শোনা যায় সেই সময় থেকে এখানে পুজো হয়ে আসছে।
পরে মহেন্দ্রপুর গ্রামে মুসলমান ধর্মের মানুষ বসবাস করতে আরম্ভ করে। গ্রামের ওই বেদীকে অক্ষত রেখেই চারদিকে ঘর বাড়ি তৈরি শুরু হয়। আজ চারপাশে মাঝে মধ্যেই ধর্ম নিয়ে নানা অশান্তির কথা শোনা যায় কিন্তু আজ পর্যন্ত এখানে তার ছিটেফোঁটা প্রভাবও পড়েনি। এ গ্রামের সকলেই চায় আগামী দিনও এখানে যেন এই সম্প্রীতির আবহাওয়া বজায় থাকে। তাই মহেন্দ্রপুরের কালীপুজো হিন্দুদের হলেও এই দিনটির জন্য মুসলিমরাও অপেক্ষা করে। পূজো করে হিন্দুরা কিন্তু অনান্য কাজ করে এখানকার মানুষ।
সম্প্রীতির কালীপুজোর আরেকটি উদাহরণ হল পুরুলিয়ার হিড়বহাল গ্রামের ‘মা ভদ্রকালীর এবং সত্য পীরের মন্দির’। এখানেও কয়েকশো বছর ধরে ভদ্রকালী ও পীরের উপাসনা চলে আসছে। পুরুলিয়ার ২ নং ব্লকের এই গ্রামের এই মন্দিরে পীর বাবাকে সত্যনারায়ণ রূপে পুজো করেন পুরোহিত৷ শুধু তাই নয়, ওই পুরোহিত কোনও ব্রাহ্মণ নন৷ বংশ পরম্পরায় কালীপুজোর দিনও এই হিড়াবহাল মন্দিরের পরিবেশ বেশ জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে৷ ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সেই পুজোয় অংশ নেন৷ ভদ্রকালীর মন্দির হওয়ায় এখানে বলি হয়। তাতেও হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ অংশ নেন৷ পুরুলিয়া ছাড়াও, আশেপাশের জেলা থেকে, এমনকি প্রতিবেশী রাজ্যের লোকজনও পুজো দিতে আসেন এই মন্দিরে৷
কালীপুজো ঘিরে সম্প্রীতির চিত্র ফুটে ওঠে মালদা জেলার হাবিবপুর ব্লকের বুলবুলচন্ডী অঞ্চলের মধ্যেমকেন্দুয়া গ্রামের কালীপুজোয়। এখানকার কালী পুজোর পুরোহিতের নাম শেফালী বেওয়া। একজন মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলা কালী পুজো করবেন, শুরুতে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই আপত্তি জানিয়েছিল কিন্তু পরে তারাই আবার এই পুজোয় সায় দেন। তারপর থেকে গত ৩৫ বছর ধরে ভূত-চতুর্দ্দশীর পরের দিন অমাবস্যায় কালীপুজো করে আসছেন শেফালি বেওয়া ও তাঁর পরিবার।