জোট সরকার ভারতের জন্য কোনো নতুন বা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কোনো কোনো সময় এক ডজনের মতো দল নিয়েও জোট গঠিত হয়েছে। অনেকে বলেন, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার ও প্রবৃদ্ধি এসেছে জোট সরকারের অধীনে। এক্ষেত্রে কংগ্রেস ও বিজেপি দুই দলেরই অবদান রয়েছে। তবে ২০১৪ সালের পর এই প্রথমবারের মতো জোট সরকার গঠন করতে হয়েছে ভারতকে। কারণ কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ইতিমধ্যে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন মোদী। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, বিরোধীদের উত্থানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন তিনি। বর্তমানে এনডিএ জোটের ওপরই বিজেপির ভাগ্য নির্ভর করছে।

তাই সবার কাছে একটাই প্রশ্ন মোদী কি জোট সরকার চালাতে পারবেন। কারণ তিনি এর আগে কখনই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। প্রধানমন্ত্রী কিংবা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি একক সংখ্যারিষ্ঠতা নিয়ে সরকার চালিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে মোদী কী তার আধিপত্যবাদী মনোভাব ও ভিন্ন প্রকৃতির আঞ্চলিক মিত্রদের নিয়ে চলতে পারবেন? তিনি কি নিজের ইমেজ ধরে রাখার জন্য দলের মধ্যে থাকা অন্যান্য নেতা ও মিডিয়ার ওপর চাপ তৈরি করবেন? অনেকেই মনে করছেন, জোট সরকারের মধ্যে খুব একটা স্বস্তিতে থাকবেন না নরেন্দ্র মোদী। জনতা দল ইউনাইটেড ও তেলেগু দেসম পার্টির মতো দুইটি আঞ্চলিক দলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে মোদীকে। এই দুই দলের আসন ২৮টি। তাছাড়া এই দুই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঝানু রাজনীতিবিদ নিতিশ কুমার ও এন চন্দ্রবাবু নাইডু। এর আগে তারা বিজেপির জোট সরকারে থাকলেও মতপার্থক্যের কারণে ক্ষমতাসীন দল ছাড়ার নজির রয়েছে।

জোট সরকার খুব স্বাভাবিক বিষয় হলেও ভারতের ক্ষেত্রবিশেষে এবারের প্রেক্ষাপট আলাদা। যখন একটি সরকার মাত্র দুটি বা তিনটি দলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখন সেটা খুব টেকসই হয় না। কারণ একটি দলও যদি সরে দাঁড়ায় তাহলে সরকার ভেঙে যায়। অনেকেই মনে করছেন মোদীর অধীনে জোট সরকার গণতন্ত্রের জন্য ভালো হতে পারে। কারণ এমন পরিস্থিতিতে মোদীর আধিপত্য কমবে, বাড়বে ক্ষমতার ভারসাম্য, উজ্জীবিত হবে বিরোধী দলগুলো। তাছাড়া আমলাতন্ত্র, বিচারবিভাগ ও গণমাধ্যমগুলো আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কয়েকটি দলের সমন্বিত জোট সরকার চালিয়ে ছিলেন বিজেপির প্রভাবশালী নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী। তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোকে বেসরকারীকরণ করেছেন, বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধা দিয়েছেন, এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করেছেন, বাণিজ্য বাধাগুলো শিথিল করেছেন। এমনকি আইটিখাতের বিপ্লবেও অবদান রেখেছেন। তিনি পারমাণবিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও এক দশকের পুরনো স্থগিতাদেশের অবসান ঘটিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা কমিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ঐক্যেরভিত্তিতেই তিনি এসব ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। তবে অতীতের চেয়ে মোদীর বর্তমান জোট অন্য প্রকৃতির। তবে জোট নেতা হিসেবে মোদীর আধিপত্য থাকতে পারে। কারণ তার দল ২৭২ আসনে জয় না পেলেও ২৪০টি আসনে জয় পেয়েছে।

এর আগে ১৯৯১ সালে ২৩২ আসন নিয়েও সফলভাবে সরকার পরিচালনা করতে পেরেছিল কংগ্রেস। এমনকি ২০০৪ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে ১৪৫ ও ২০৬ আসন পেয়েও সফলভাবে মেয়াদ শেষ করতে পেরেছিল কংগ্রেস। এখন তো দলের অধিকাংশ এজেন্ডা বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। যেমন কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করা, রাম মন্দির নির্মাণ। তবে বর্তমান জোট কি মোদীর সুর নরম করাতে পারবে? বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর মোদীর যে মনোভাব সেক্ষেত্রে। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও মোদী মুসলিমদের টার্গেট করেছিলেন। ভারসাম্য বজায় রেখে জোটের রাজনীতিতে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখন প্রধান প্রশ্ন হলো কোন কোন ইস্যুতে জোটের অংশীদার ও বিজেপি একমত হতে পারবে।

দক্ষিণের রাজ্যগুলো মনে করছে মোদী নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে, এমন রাজ্যে আসন সংখ্যা বাড়াতে পারে। জোট সরকারের অধীনে মোদীকে কেন্দ্র ও আঞ্চলিক ইস্যুতে অংশীদারদের কথা শুনতে হবে। টিডিপি ও জেডিইউ দুই দলই নিজেদের রাজ্যের জন্য বিশেষ মর্যাদা চেয়েছে অর্থাৎ আরও কেন্দ্রীয় ফান্ড বাড়াতে হবে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যেও মোদীকে কর্মসংস্থান তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়তে হবে। ভারতের অর্থনীতিতে কৃষি, জমি ও শ্রমখাতে অনেক কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।মোদীর যেকোন কিছু অর্জনের জন্যই এবার জোটের সঙ্গে পরামর্শমূলক পদ্ধতির প্রয়োজন হতে পারে। এই কারণে অনেকেই মনে করছেন, সব সময় আধিপত্য নিয়ে থাকা মোদীর জন্য সম্মতির রাজনীতি খুব সহজ হবে না।