শুক্র হল সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ। সূর্য ও চাঁদের পরে আকাশে যাকে স্পষ্ট দেখা যায়, সেটাই হচ্ছে শুক্র গ্রহ। রোমানরা একে প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের নামে নামকরণ করেছে। কোনো দেবীর নামে নামকরণ করা এটি একমাত্র গ্রহ। ৭ম শতাব্দীতে ব্যাবিলনীয়রা প্রথম শুক্র গ্রহের কথা লিপিবদ্ধ করে। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপের সাহায্যে শুক্র গ্রহের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। গ্রহটি যেহেতু সূর্যের অনেক কাছে, তাই তাপমাত্রাও অনেক বেশি। প্রায় ৪৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় লোহাও প্রায় গলে যায়। গ্রহটির গঠন অনেকটা পৃথিবীর মতো, অর্থাৎ পাথুরে গ্রহ। এর কেন্দ্রে রয়েছে লোহা এবং খনিজ পদার্থ। তবে গঠন এক হলেও বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর চেয়ে আলাদা।
গ্রহটি পাথুরে কিন্তু মানুষের বসবাসের যোগ্য নয়। কারণ এই গ্রহের বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত বিষাক্ত। পৃষ্ঠটান এতটাই শক্তিশালী যে মানুষকে মেরে ফেলার জন্য এই চাপই যথেষ্ট। অত্যাধিক কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকায় পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বেশি। এর বায়ুমণ্ডল অনেকটা গ্রিনহাউস এফেক্টের মতো কাজ করে। তাই শুক্রের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর আগে শুক্র গ্রহের জন্ম, সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের সঙ্গে। এর কোনো উপগ্রহ নেই। উপগ্রহ না থাকার ব্যাপারে দুটি মতবাদ রয়েছে। এক. বুধ সূর্যের অনেক কাছে থাকায় এর কোনো উপগ্রহ নেই। দুই. এক সময় শুক্রের উপগ্রহ ছিল। পরে বড় কোনো মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় গ্রহটির। আর এতেই উপগ্রহটি শুক্রের সঙ্গে মিশে গেছে। যাই হোক, শুক্রের ঘূর্ণন অত্যন্ত ধীর। পৃথিবীর ২৪৩ দিন সমান শুক্রের একদিন। আর এক বছর হয় পৃথিবীর ২২৫ দিনে। শুনতে অদ্ভুত হলেও শুক্রের বছরের দৈর্ঘ্য থেকে দিনের দৈর্ঘ্য বড়। এই অদ্ভুত ঘটনার কারণ শুক্র গ্রহের অস্বাভাবিক ঘূর্ণন।
সৌরজগতের বেশির ভাগ গ্রহ পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘোরে। কেবলমাত্র শুক্র ও ইউরেনাস ব্যতিক্রম। শুক্র নিজের অক্ষের ওপর পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘোরে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোনো বড় গ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে শুক্র গ্রহের অক্ষ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছিল। ফলে ঘূর্ণনের দিকও হয়ে গিয়েছে উল্টো। অবশ্য জোড় দিয়ে বলার মতো কোনো ব্যাখ্যা এখনো বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি। সূর্য থেকে শুক্র গ্রহের দূরত্ব নির্দিষ্ট নয়। তবে গড় দূরত্ব ১০ কোটি ৮৯ লাখ কিলোমিটার। শুক্রের ব্যাস ১২ হাজার ১০৪ কিলোমিটার। শুক্র থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্ব প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ কিলোমিটার। গ্রহটির ভর ৪.৮৭ × ১০২৪ কিলোগ্রাম, যা পৃথিবীর চেয়ে ১৮ ভাগ কম।
শুক্র গ্রহের সর্বোচ্চ পর্বত ম্যাক্সওয়েল পর্বত। এর উচ্চতা ১১ কিলোমিটার। এছাড়াও রয়েছে অ্যাফ্রোদিতি টেরা। যা পৃথিবীর তিব্বত মালভূমির চেয়েও বড়। গিরিখাতের মধ্যে রয়েছে গিসাভি গিরিখাত ও হাতোর গিরিখাত। আরও রয়েছে ৭৫ কিলোমিটার ব্যাসের বিশাল আগ্নেয়গিরি সাপা ভেনেরিস। শুক্র গ্রহ সম্পর্কে জানতে এখন পর্যন্ত ৫০টি মিশন পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সফল হয়েছে ৩১টি। ভবিষ্যতে এ গ্রহে আরও মিশন পরিচালনার পরিকল্পনা করছে মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলো। ২৪ ঘণ্টায় দিন আর ১২ মাসে বছর দেখে অভ্যস্ত আমরা পৃথিবীর মানুষেরা কি ভাবতে পারি সৌর জগতে এমন গ্রহও আছে যেখানে এক বছরের চেয়ে এক দিন বড় আর সেকারণেই শুক্র বাতিক্রমধর্মী। ভেনাস বা শুক্র নিজ অক্ষের মধ্যে এতটা ধীর গতিতে ঘোরে যে এর এক দিন পৃথিবীর প্রায় ২৪৩ দিনের সমান। অথচ নিজের কক্ষপথে পৃথিবীর ২২৫ দিনে গ্রহটি সূর্যের চারিদিকে একবার পরিক্রম করে। অর্থাৎ,পৃথিবীর ২২৫ দিনে শুক্র গ্রহের এক বছর।
তবে শুক্র সম্পর্কে এসব কথা জেনে গ্রহটিতে ভ্রমণের ইচ্ছাপ্রকাশ খুব ভুলে হবে। কারণ এটি একটি মৃত গ্রহ। এবং একইসঙ্গে সৌরজগতের উষ্ণতম গ্রহ। এটি কার্বনডাই অক্সাইডের তৈরি একটি মৃত্যুফাঁদ! শুক্রর বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৯৬ শতাংই কার্বনডাই অক্সাইড, ৩.৫% নাইট্রোজেন ও সামান্য পরিমাণে অন্যান্য গ্যাস আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সালফারডাই অক্সাইড। গ্রহটির পুরু মেঘের স্তর ভেদ করে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে কিন্তু বের হতে পারে না। এই গ্রিন হাউজ ইফেক্টের ফলেই সময়ের পরিক্রমায় গ্রহটিতে এই ভূতুড়ে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অচিন্তনীয় বায়ুচাপ শুক্রের ভুপৃষ্ঠে আপনাকে দাঁড়াতেই দেবে না। নাসার বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হচ্ছে, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তুলনায় ৭৫-১০০ গুণ বেশি বায়ুচাপ শুক্রপৃষ্ঠে।
তবে বিজ্ঞানীরা বলেন, এই মৃত্যুপুরী নাকি আনুমানিক ৪ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর মতোই বাসযোগ্য ছিল। নদী ছিল, সাগর ছিল, প্রাণের স্পন্দনও হয়তো ছিল। কিন্তু প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছরের পরিক্রমায় আমাদের সূর্য তার আগের অবস্থার চেয়ে ২৫% বৃদ্ধি হয়েছে। একই সঙ্গে শুক্র গ্রহের তাপমাত্রাও বহুগুণে বেড়েছে, আর বাষ্প হয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে এর নদী, সমুদ্র এবং সব ধরণের জলাধার। এই সময়েই পৃথিবীতে সহনীয় তাপমাত্রার উন্মেষ ঘটেছে। শুক্র গ্রহের এই সুদূর অতীত থেকে আমরা ধারণা করতে পারি সৌর জগতের সূর্যের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনে আমাদের বসুন্ধরা এক সময়ে শুক্রের মতো নরকগ্রহে পরিণত হবে।