‘পৃথিবীর এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পেরোতে গিয়ে আমরা এর-ওর-তার কাছ থেকে প্রচুর সাহায্য উপদেশ আশীর্বাদ পেয়ে থাকি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা যা হয়ে উঠি তা আমাদের নিজস্ব কর্মফল, কেউ-কেউ ঠগ জোচ্চর হই, কেউ কেউ দশটা-পাঁচটা কলম-পেষা সংসার ধর্মভীরু করণিক, কচ্চিৎ কেউ-কেউ বা রবি ঘোষের মতো মস্ত বড় মাপের স্রষ্টা, যাঁকে বিপ্লবী বলে আখ্যা দিতে, আমার দিক থেকে অন্তত, কোনও অসুবিধে নেই’। একজন অভিনেতা সম্পর্কে মন্তব্যটি অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র-র, যিনি রবি ঘোষের চরিত্র চিত্রণে ‘রবিকথন’ শীর্ষক নিবন্ধে ব্যয় করেছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার শব্দ। সচরাচর একজন অভিনেতার অভিনয় দক্ষতা, মঞ্চ অথবা চলচ্চিত্রে তাঁর গুরুত্ব সম্পর্কে কলম ধরেন উল্লেখিত ওই দুই মাধ্যমের সমালোচক কিংবা কলাকুশলী। কোনও সমাজতত্ত্ববিদ কিংবা অর্থনীতিবিদের আলাপচারিতায় একজন জনপ্রিয় অভিনেতাকে এত গভীর ও আন্তরিক শ্রদ্ধায় ঠাঁই পেতে দেখা যায় না। তার মানে রবি ঘোষ কেবলমাত্র একজন কৌতুক অভিনেতা নন। রবি ঘোষ, রামা কিংবা ধনঞ্জয় অথবা নটবর মিত্তির-শেখর-বাঘা ইত্যাদি চরিত্রগুলির সুনির্দিষ্ট ফ্রেম কিংবা মুখোশ অথবা মুদ্রাদোষেই বাঁধা থাকেন না অথচ এঁদেরই মাঝে বসে তাঁর নিজের মুদ্রাদোষে তিনি একাই হতে থাকেন আলাদা।
রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার থেকে রবি ঘোষ হওয়ার ইতিবৃত্তে রয়েছে আকীর্ণ অর্থাভাব, হতজীর্ণ সংসারের মালিন্য, প্রতিদিন দুরূহ থেকে দুরূহতর হয়ে ওঠা জীবন, সেই পরিবেশকে দীর্ণ করে স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া, সাধনা সফল করা- এতোসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে কৃতী হওয়াটা মোটেও সহজ কাজ নয়। কিন্তু রবি ঘোষ পেরেছিলেন তাঁর স্বপ্নকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে এনে উপস্থাপন করতে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা রবির ছিন্নমূল পরিবার আশ্রয় পেয়েছিল কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটের পরিসরহীন স্যাঁতসেতে ভাড়া বাড়িতে। বাবা আলিপুর কোর্টে নামমাত্র একটি কাজ করতেন। সব অর্থেই তিনি নিঃস্ব মানুষ, কিন্তু নিঃস্বতার মধ্যেও সম্বল তাঁর চরিত্রবল, ন্যায়-নীতি বোধ। আদালতের সেরেস্তাদারের সামান্য চাকরিতে অঢেল উপরির সুযোগ অথচ নির্মম দরিদ্রের নিষ্ঠুর চাপেও নিজেকে সংযত রেখেছিলেন। ফলত শৈশব থেকেই মর্মান্তিক জীবন যন্ত্রণা সঙ্গী করেই বেড়ে উঠেছিলেন রবি। কিন্তু সারাজীবনে কখনও নিজের দারিদ্রতা, নিঃস্বতা, দুর্ভোগকে হাপিত্যেশ বর্ণনায় পরিবেশন করেননি। কাছের মানুষদের সঙ্গে সেই হৃদয় বিদারক বিবরণ কখনো কখনো ঠোঁটের কোনে কৌতুকের ছোঁওয়ায় ভাগ করেছেন।
সাউথ সুবার্বন মেন স্কুল, আশুতোষ কলেজের দিনগুলি রাতগুলি কেটেছে নিদারুন অভাব-অনটন, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মালিন্য ঠাসা কুম্ভিপাকে অথচ নিজের বুকের শেল নিয়ে রবি অবিচল। মা-বাবাকে নিয়ে তাঁর সুনিবিড় গর্ব-প্রীতি-ভালবাসা-ভক্তির সম্ভার। এরই পাশাপাশি আছে রবির নাট্যচর্চা। সেখানে মন-প্রাণ সবটাই ঢেলে দিয়েছেন। রক্ষণশীল নীতিবাগীশ বাবা ছেলের এহেন নাট্যচর্চা একেবারেই বরদাস্ত করতেন না, কারন যে অভাব-অনটনের অন্ধকারে তাঁরা মুখ থুবড়ে রয়েছেন সেখানে বাড়ির জ্যেষ্ঠ্য সন্তান আলোর বর্তিকা হাতে নিয়ে অন্ধকার থেকে উদ্ধার করবে সেটাই সাধারন নিয়ম। বাবা-মা-বোন-ভাই আশা করবেই। কিন্তু রবি সেই ব্যাকরণে মান্যতা না দিয়ে ব্রেখট থেকে স্ট্যানিস্লাভাস্কিতে গভীর মনোযোগী, উৎপল দত্তর নাটকে মগ্ন। বাবার সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলে বাড়িতে ঢুকছে-বেড়চ্ছে। অভয় প্রশ্রয় মিলছে মায়ের আঁচল। ইতিমধ্যে কলেজের পাঠ চুকে গেলে তাঁর বাবা কোর্টের উপরওয়ালাকে বলে-কয়ে সেরেস্তাদার দফতরেই একটি অতি সামান্য কাজ জুটিয়ে দেন। কয়েক বছর রবি দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র অনিচ্ছা নিয়েই অপছন্দের সেই কাজ করলেও অভিনয়ই তাঁকে সুনিবিড় করে রাখে। আদালতের কাজে অন্তরের সায় পান না রবি।
একদিন সেরেস্তাদার দফতরের কাজ ছেড়ে বাবা-মাকে কুপিত করে রবি অভিনয় চর্চাতেই মনোযোগী হন। সকলের অজান্তেই রবি ‘অঙ্গার’- এর সনাতন ‘কিছুক্ষণ’, ‘মেঘ’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, ‘অভিযান’, ‘আগুন’, ‘পলাতক’, ‘ন্যায়দন্ড’, ‘ছায়াসূর্য’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘অবশেষে’, ‘শুভা ও দেবতার গ্রাম’, ‘আরোহি’, ‘মহাপুরুষ’, ‘স্বপ্ন নিয়ে’, ‘পাদি পিসির বর্মি বাক্স’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘বাঘিনী’, ‘কোরাস’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘জণঅরন্য’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’-র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা হন। অনেকেই কৌতুক- অভিনেতার তকমা এঁটেছেন রবি ঘোষের অভিনয় প্রতিভায়। কারণ তা অত্যন্ত ভুল, তাঁর অভিনয় দক্ষতার বিশ্লেষণে উৎপল দত্ত কিংবা সত্যজিৎ রায়ের প্রভাব বিবেচনাও জরুরী নয়। কারন রবি ঘোষ তাঁর চরিত্র নির্মাতা থেকে পরিচালকের অনুশাসন মাথায় রেখেও সেই চরিত্র চিত্রণে তাঁর মুদ্রাদোষের ছাপ রেখেছেন। কখনো তা তাঁর ভ্রু বা চিবুকের ক্ষনিক মুহুর্তের ব্যঞ্জনায় কিংবা কথা বলার বিশিষ্ট ভঙ্গিমায়। আসলে রবি ঘোষ সম্পূর্ণ ভিন্ন মার্গের অভিনেতা। তাঁর উচ্চতা যেমন অভিনব বিচরণও তেমনই অসাধারণ। অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে কৌতুকের যে বিচ্ছুরণ তা কিন্তু একেবারেই মজা নয়। নিছক মজাটাই যেন এক উত্তরণ যা অন্য মার্গের অভিনেতার একটি পরিচয় মাত্র। অভিনেতা রবি ঘোষের অভিনীত যে কোনও চরিত্রের মুখ মনে করে দেখুন কেমন করে তিনি বদলে দিতেন মুখের রেখা, চোখের দৃষ্টি, সেই অভিব্যক্তি এবং অভিনয় ভাষা- দয়া করে একে কমিক দাগিয়ে দেবেন না।
1 Comment
লেখার মধ্যে সব ছবির নাম দিতে হবে এমনটা নয়,তবে রবি ঘোষ এর উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে গল্প হলেও সত্যি র নামটা বোধহয় দেওয়া প্রয়োজন।