তিনি ধর্মপরায়ণ, বীর, ধীর, সুসভ্য, সুকান্ত, জ্ঞানী, গুণী ইত্যাদি শতাধিক গুণাত্মক বিশেষণে ভূষিত। অন্যদিকে আরেকজন বিকলাঙ্গ (দশমুণ্ড), স্বৈরাচারী, অসভ্য, রাক্ষস, কামুক ইত্যাদি শতাধিক দোষাত্মক বিশেষণে দুষ্ট। মহাকাব্য রামায়ণের নায়ক রাম আর খলনায়ক রাবণকে এইভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকই কি তাই? নাকি আর্য ঋষি বাল্মীকি তাঁর আর্যপ্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষ থেকেই রামকে প্রদীপ্ত আর রাবণকে হীনপ্রভ করার জন্যই একজনকে প্রোজ্জ্বল আর অন্যজনকে মসিময় করতেই দক্ষ্যতার সঙ্গে নিপুণ হাতে রামায়ণের পাতায় এমন ছবি এঁকেছিলেন? কিন্তু তাঁর আঁকা রাবণ চরিত্রের রঙ ও রেখার ফাঁক ফোঁকরেই রাবণের জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, সঙ্গীত প্রীতির পরিচয় ছিটেফেঁটা হলেও প্রকাশ পেয়েছে, যার ঔজ্জ্বল্য মহান রামের উজ্জ্বলতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
রাবণ ছিলেন রাক্ষস এবং ব্রাহ্মণ উভয়ই। অর্ধেক ব্রাহ্মণ আর অর্ধেক রাক্ষস রাবণের পিতা ছিলেন বিশ্বশ্রব ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং মা কৈকসী ছিলেন রাক্ষস। রাবণ শিবের পরম ভক্ত ছিলেন। বলা হয় যে রাবণের মতো কোনো শিবভক্ত আর নেই। তবে জৈন ধর্মে রাবণের উল্লেখ আছে। রাবণকে জৈন ধর্মের ৬৪ জন শলাক পুরুষের মধ্যে গণ্য করা হয়। রামায়ণে রাবণকে বলা হয়েছে দশানন। রাবণের দশটি মাথা বাস্তবিকই ছিল না, কথিত রাবণের গলায় গোলাকার ন’টি পুঁতি ছিল যে কারণে রাবণের দশটি মাথা দেখা যেত। এছাড়া তাঁর মাথার অর্থাৎ জ্ঞান ছিল দশটি মুণ্ডের সমান। তাই রূপকে রাবণ দশমুণ্ডু রূপে অঙ্কিত হয়েছেন।
রাবণের রাজমহলকে কখনো লঙ্কাকেও ‘স্বর্ণপুরী বলা হয়। এতে রাবণের ঐশ্বর্য, শিল্প-নিপুণতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধের পরিচয় মেলে। লঙ্কায় সীতা ছিলেন রাবণের অশোক কাননে। যা আসলে রাবণের প্রমোদ উদ্যান, সেই বাগানে প্রবেশ করলে কারো আর শোকতাপ থাকতো না। তাই তার নাম ছিল অশোক কানন। সেই বাগানও রাবণের সুরুচি ও সৌন্দর্যপ্রিয়তার পরিচয়। তাছাড়াও রাবণ ছিলেন একজন উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ। অসংখ্য ফল-ফুল ও লতাগুল্মের গাছকে তিনি এক জায়গায় সমাবেশ করিয়েছিলেন। খনা বলেছেন,“ডেকে কয় রাবণ, কলা-কচু না লাগাও শ্রবণ।”
রাবণকে মহাজ্ঞানী, পণ্ডিত এবং সঙ্গীতপ্রেমী বলাই যায়। তাঁর রচিত একাধিক গ্রন্থের মধ্যে শিব তান্ডব স্তোত্র, রাবণ সংহিতা এবং অরুণ সংহিতা উল্লেখযোগ্য। বেদ শাস্ত্রে পারদর্শী রাবণ বেদের সবকটি শাখার জ্ঞান লাভ করেছিলেন। বেদের অন্তর্ভুক্ত ছিল সঙ্গীত শাস্ত্রও। তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। তিনি বীণা বাজানোতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং “রাবণ বেণী” ও “রুদ্র বীণা” নামে দুটি বীণা তৈরি করেছিলেন। রামায়ণেও আছে যে, রাবণ প্রায়শই সীতাকে বীণা বাজিয়ে শোনাতেন। সেই সময় রাবণের সংগীত রচনা এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দক্ষতা তাঁকে একজন বিখ্যাত শিল্পী করে তুলেছিল। তার সংগীত লঙ্কার রাজদরবারে এবং সমগ্র রাক্ষস জাতির মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। রাবণের বিশ্বাস ছিল যে, সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করা যায় এবং তিনি নিয়মিত মহাদেবের পূজা করার সময় বীণা বাজাতেন।
কথিত ভারতে রুদ্রবীণার প্রচলন করেছিলেন রাবণ। রাবণের রাজসভায় নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশিত হত। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীরা রাবণের রাজসভায় গান পরিবেশন করতেন।একথাও বলা হয় যে রাবণ যুদ্ধক্ষেত্রেও সঙ্গীতের ব্যবহার করতেন। সৈনিকদের মনোবল বাড়ানোর জন্য যুদ্ধের গান গাওয়া হত। রাবণ অনেক সঙ্গীত রচনা করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। যদিও সেগুলি “শিব তাণ্ডব স্তোত্র”- এর মতো জনপ্রিয় হয়নি। যদিও রাবণ রামায়ণ এবং হিন্দুশাস্ত্রে একজন খলনায়ক চরিত্র হিসেবে চিত্রিত, তবুও তাঁর সংগীতের প্রতি অনুরাগ ও দক্ষতা অস্বীকার করা যায় না।
শ্রী রামচরিত মানসে প্রতীক হিসেবে রাবণের চরিত্রকে আঁকা হয়েছে। যে রামায়ণ পড়লেই মনে হয়, রাবণের নীতিহীন কর্মকাণ্ডের কারণেই তিনি এবং তাঁর বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে রাবণের মূর্তি আমাদের মনে শুধুই রাক্ষস হিসেবেই থেকে যায়। কিন্তু তিনি মহাপণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাহসী যোদ্ধা এবং একজন দার্শনিক! রাবণের তিনটি গুণ ছিল— সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। বাল্মীকি রামায়ণ অনুসারে, বিশ্রবা ছিলেন ঋষি পুলস্ত্যের পুত্র। বিশ্রবা ঋষি ছিলেন মুনিদের মধ্যে অতি শ্রদ্ধাভাজন। এহেন মহর্ষি বিশ্রবারের পুত্র ছিলেন রাবণ। বিশ্রবা নিকষার রূপে মোহিত হয়ে বিয়ে করেছিলেন। নিকষা ছিলেন রাক্ষস বংশের। রাবণের দুই ভাই কুম্ভকর্ণ এবং বিভীষণ এক বোন শূর্পনখা। রাবণ হয়ে ওঠেন একইসঙ্গে জ্ঞানী ব্রাহ্মণ এবং মায়াবী জ্ঞানসম্পন্ন রাক্ষস।