আসানসোল মহকুমা যেমন কয়লা ও ইস্পাত শিল্পের জন্য বিখ্যাত তেমনি বিভিন্ন জাগ্রত দেব-দেবীর আর্শীবাদ পুষ্ট ও মহিমা মন্ডিত। আসানসোল শহরের উত্তরে ক্লেদবাহী শীর্ণকায় নুনীয়া নদীর তীরে অধিষ্টিতা রাঢ় বাংলার জাগ্রত দেবী মা শ্রীশ্রী ঘাঘর বুড়ি। কিন্তু কে এই ঘাঘর বুড়ি? রাঢ় বঙ্গে লোকপ্রিয় দেবী চণ্ডী মূলত বৌদ্ধ দেবী চুন্ডা-রই নামান্তর। এই রাঢ় বঙ্গের এক জাগ্রত দেবী ঘাঘর বুড়ি কে চন্ডীর এক রূপ বলে কল্পনা করা হয়।

ঘাঘরবুড়ির চণ্ডীমন্দির যে শুধু অতি প্রাচীন তাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক অলৌকিক উপাখ্যান এবং কিংবদন্তি। প্রায় ৫০০ বছর আগে আজকের আসানসোল মহানগর ছিল ধূ ধূ করা মাঠ এবং আসান গাছের জঙ্গল। জনমানবহীন প্রান্তরে দু একটি বাড়ি নিয়ে ছোট ছোট গ্রাম। সেই ছন্নছাড়া গ্রামগুলিতে যজমানি করতেন গরীব ব্রাহ্মণ কাঙালীচরণ চক্রবর্তী। প্রতিদিন নুনিয়া নদী পেরিয়ে ওপারের গ্রামগুলিতে যেতেন পুজো অর্চনা করতে, আবার ফিরে আসতেন। এইভাবেই বহুকষ্টে দিন গুজরান করতেন। এক শীতের দিনে যজমানের ঘরে পুজো করে নুনিয়া নদী পেরিয়ে এসে ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত কাঙালীচরণ এক গাছতলায় শুয়ে পড়লেন। কাতর ভাবে ডাকতে লাগলেন মা চণ্ডীকে।


কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ কীসের আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। বুঝতেই পারেননি যে এত বেলা হয়ে গেছে। যখন জেগে ছিলেন তখন সূর্যদেব মাথার ওপরে ছিলেন, আর এখন প্রায় অন্ধকার। বাঁশের লাঠির ঠুক ঠুক আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দও শোনা যাচ্ছে না। এরপর দেখলেন এক ঘাগরা পরিহিত বুড়ি ঠুক ঠুক করতে করতে বাঁশের লাঠি নিয়ে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছেন। সেই বুড়ি কিছু না বলে কাঙালীচরণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঙালীচরণের চোখ যেন ঝলসে গেল, সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ ঝলক বয়ে গেল। তারপর আবার ঘুমে ডুবে গেলেন। ঘুমের মধ্যেই শুনলেন সেই বুড়ি বলছেন, ‘তোর আর উঞ্চবৃত্তির দরকার নেই, তোর কোলেই দেখবি তিনটি ছোট পাথরের ঢিবি রেখে এসেছি। মাঝখানে আমি – মা ঘাঘরবুড়ি, আমার বাঁয়ে মা অন্নপূর্ণা, ডাইনে পঞ্চানন মহাদেব। এইখানেই মন্দির প্রতিষ্ঠা কর, আর কোথাও যেতে হবে না।’ মা ঘাঘরবুড়ির আদেশে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৬২০ সালে।এই পাথরের ঢিবিগুলিকেই ফুল এবং রুপোর গয়নায় সাজানো হয়। আর সেই ১৬২০ সালের ১লা মাঘকে স্মরণ করে প্রতি বছর মন্দিরের সামনের মাঠে বসে ঘাঘরবুড়ি চণ্ডীমাতার মেলা।

জানা যায় বহু প্রাচীন কাল থেকে অনাচ্ছাদিত মন্দিরে, গাছ তলায় পুজা হয়ে আসছে মা ঘাঘর বুড়ির। তারপর মন্দির হয়েছে। কোন মূর্তি নেই। শুধু তিনটি শীলা। ঘাঘর শব্দের অর্থ হল ঝাঁজ বাদ্য ও ঘুঙুর। পুরানে দেব-দেবীর বিভিন্ন পুজা পদ্ধতির উল্লেখ আছে। তার মধ্যে নৃত্য গীত-বাদ্য সহকারে বহু দেবীর পূজার প্রচলন ছিল। মন্দির সংলগ্ন এলাকাটি আদিবাসী অধ্যুষিত। অতীতে যে পুজো নৃত্য-গীত-বাদ্য সহকারে হত সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ঘাঘর শব্দের আরেকটি অর্থ হল নদী। নুনীয়া নদীর দক্ষিন তীরে মন্দির। এমনও হতে পারে যে এই জন্যই দেবী চন্ডীর এখানে নাম হয়েছিল ঘাঘর বুড়ি।

একটা প্ৰচলিত তত্ত্ব হল, ঘাগর শব্দটি ঘাগরা থেকে এসেছে, ঘাগরা পরিহিত এক বৃদ্ধার রূপে মা চণ্ডীর এখানে নাকি আবির্ভাব ঘটেছিল সপ্তদশ শতকে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ কাঙাল চক্রবর্তীর সম্মুখে। বৃদ্ধা এই তিনটি শিলা দেখিয়ে পুজো করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে ঘাগর বুড়ি নাম, এরকম একটি কাহিনী প্ৰচলিত। কিন্তু ঘাগর শব্দটির মূল অর্থ এক প্রকার বাদ্য। সেই ছড়াটা স্মরণ করুন: আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, ঢাক মৃদঙ্ ঘাগর বাজে।

আসলে বুড়ি হিসাবে কল্পনা করে তাকে কিছুটা মাতৃ বন্দনায় পুজো করা হয়। আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে মাতৃ রূপের সঙ্গে শক্তি রূপের মিল আছে। বলা দরকার অতিবৃদ্ধা মাতা হিসেবে পৃথিবী বা প্রকৃতিমাতৃকার উপাসনা আমাদের তন্ত্রধর্মে বলে শুধু নয়, সারা পৃথিবীরই মাতৃধর্মের একটি প্ৰচলিত বিধি। আসানসোল সংলগ্ন সাঁওতাল পরগণায় বুড়ি অন্তনামের অনেক মাতৃদেবীর সন্ধান পাওয়া যায়: কিলাবুড়ি, সাতাইবুড়ি, নুনাবুড়ি প্রভৃতি। আমাদের শিশুরঞ্জক রূপকথায় যে জুজুবুড়ি, তিনিও এরকমই মাতৃকার একটি নেতিবাচক রূপান্তর, এলিটশ্রেণী দ্বারা বিড়ম্বিত চিত্র। যদিও ঘাঘর বুড়ি সম্পর্কে এই বিড়ম্বনার কথা উঠে আসতে পারে। যেমন আগে দেবীর পুজো করতো প্রান্তিক মানুষেরা। পরবর্তীতে দেখা গেল ব্রাহ্মণদের হাতে পুজোর ভার উঠল।
ট্রেনেঃ আসানসোল রেল স্টেশন কিংবা দুর্গাপুর রেল স্টেশন থেকে যাওয়া যায়। সড়ক পথে কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের দূরত্ব ১৭৩ কিলোমিটার যা এনএইচ ১৯ এর মাধ্যমে ৩ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের যাত্রা। কলকাতা থেকে আসানসোল ২১৩ কিলোমিটার যা এনএইচ ১৯ এবং এএইচ ১ হয়ে ৪ ঘন্টা ৩৫ মিনিটের যাত্রা।