৩য় পর্ব
প্লাটফর্মের সান্ধ্যকলীন আড্ডা শেষ করে আমরাও ফিরে চললাম যে যার গন্তব্যের দিকে। দিনান্তের অন্তিম আড্ডা মাচানতলায়। স্টেশনের মানসিক প্রতিক্রিয়া এখনও তরঙ্গায়িত হয়ে চলেছে।বারবার মনটাকে নাড়া দিয়ে চলেছে পথের মানুষগুলোর উদয়াস্ত খেটে চলা আর জাগ্ৰত জীবনবোধের অনুভব। ঈশ্বরে সঁপে দেওয়া জীবন ওদের। তাই তাঁর নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিত্যদিন। চাওয়া পাওয়ার হার নিতান্তই নগন্য। শুধু বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন। প্রতিযোগিতা নেই নিজেদের মধ্যে। ওদের পৃথিবীতে হিংসা, দ্বেষ, সংঘাতও নগন্য। খুনোখুনি কিম্বা দখলদারিও নেই তাদের মাধুকরী জীবনে।
আমাদের পরিকল্পনা মতো আমরা শুক্রবার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। বহুবার গেলেও যেন মনে হয় কিছুই দেখিনি বা যাইনি। ফাঁক থেকে যায় আমাদের পেশাগত সমীক্ষায়। তাই এবার ঠিক করেছি আঁটঘাট বেঁধে যাবো আমরা। আজ বন ফিঁকে হয়ে গেছে। সাবেক ধাঁচের বনের সেই মহামূল্যবান বনস্পতি গুলো হারিয়ে গেছে কুড়ুলের কোপে। অন্তত একশো বছর থেকে তিন চারশো বছর পুরোনো পাহাড়তলীর ছোট ছোট গ্ৰামগুলো উধাও হয়ে গেছে মানব সংস্কৃতির আগ্ৰাসনে ও প্রকৃতি পরিবেশের বিরূপতায়। সেই সব বসতি চিহ্ন ডুকরে ডুকরে কাঁদে। অনেক গ্ৰাম দূরে দূরে সরে গেছে। নতুন করে বসতি গড়ে উঠেছে চাওয়া পাওয়া আর রুটি রুজির তাগিদে।
বাঁকুড়া শহরের চেনা পথে নয়,অরণ্য সরনির বুক চিরে আমাদের দুটো বাইক ছুটে চলেছে টিলা, ডুংরি আর বন মাড়িয়ে। পাহাড়ের উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে ঢুকলে বেশ কয়েকটি বর্ধিষ্ণু গ্ৰাম পাওয়া যায়। যেমন- শিউলিবোনা, ধনকোড়া, গিধূড়িয়া, ফপসা, মেট্যালা-সহ অন্যান্য ছোট বড় গ্ৰাম রয়েছে পাহাড়কে বেষ্টনী দিয়ে। পাহাড়ের ঢালে রয়েছে বেশ বড়সড় একটা পদ্মদিঘী। পুকুরের ঘাটগুলো শূণ্য। এখনও আসেনি গাঁয়ের মানুষ। আমরা কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ঢুকে পড়লাম ফপসা গ্ৰামের ভিতরে। বাইক থামিয়ে পাশেই চন্ডীমন্ডপে নিকোনো মেঝেয় বসে পড়লাম। বেশ কয়েকজন গ্ৰাম্যবধূ সহ ছেলে বুড়ো সবাই ব্যাস্ত বেল মালা ও কুঁড়চিমালা কাটায়। তারা একমনে কাজ করে চলেছে। পাশে চালু রয়েছে মোবাইলের গান। বাঁকুড়ার মাটির গান শুনতে শুনতে তারা নিজেদের ছন্দে কাজ করে চলেছে। দু’জন মাঝবয়সী মহিলা পুঁতির মতো দেখতে বেল খোলা ও কুঁড়চি কাঠি থেকে বের করছে। এই গুলো নাকি পাঞ্জাবি, কুর্তা, কুর্তি ও চুড়িদারের উপর বসিয়ে অভিনব ডিজাইন হবে। লোকজ শিল্পের রূপান্তর ঘটে চলেছে এদেরই হাত ধরে। বহুবছর আগে থেকেই বেল মালার গ্ৰাম বলে নামডাক ছিল। প্রায় শতাধিক বৈষ্ণব পরিবারের বসবাস এখানে। এর সঙ্গে রয়েছে আরও দেড় দু’শো অন্যজাতি গোষ্ঠীর মানুষের বসতি। এক লহমায় দেখেই বোঝা যায় স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্ৰাম বলে। প্রানী পালনেও আছে স্বয়ম্ভরতা।
তিন আগন্তুককে দেখেই ধুতির উপর কোমরে গামছা বাঁধা মুরুব্বি গোছের এক প্রবীন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা, বাবুদের কুথার থাক্যে আসা হচ্ছ্যে আমাদের গাঁয়ে?’ শোভন বেশ গুছিয়ে কথা বলে। আমাদের অভিপ্রায় ও উৎসাহ শুনে তিনিই শোভনের সঙ্গে শুরু করলেন বেশ রসিয়ে কষিয়ে। কথা বলার মাঝেই এলেন গোউর ওরফে গৌরহরি দাস। যিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন সেই প্রবীন মানুষটি হলেন গোউরের কাকা, নরহরি দাস বৈরাগী। নাকের ডগা থেকে কপাল পর্যন্ত রসকলি আঁকা। গলায় ঝুলছে জপমালার ছোট্ট ঝোলা। গল্প জমে ওঠার আগেই আমি কেটে পড়লাম গোউরের সঙ্গে তার বাড়ির পথে। গোউরের ঘোর কাটেনি এখনো। বিশ্বাসই হচ্ছে না তার এই আমাদের কটক যাবার বাই দেখে। কয়েকটি বাড়ি ছাড়িয়ে এলাম গোউরের বসত বাড়িতে। নিকোনো প্রশস্ত উঠোন। চারিদিক পাথর দিয়ে নির্মিত পাকা পাঁচিল। পূবে ও দক্ষিণমুখি বড়বড় ঘর সামনে সিমেন্ট বাঁধানো চাতাল আর তুলসী মঞ্চ। গোউর পরিচয় করিয়ে দিল তার পিসিমা আনন্দ দাসীর সঙ্গে। তিনি লাউমাচা, পুঁইমাচা বাঁধার কাজ করে চলেছেন নিবিষ্ট মনে। গোউর দড়ি বালতি নিয়ে এলো কুয়ো তলায়। সঙ্গে কাঁসার ঘটি। জল তুলে হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করলো। একটু বিব্রত বোধ করায় গোউর বলে উঠলো, আজ্ঞে আপনারা হলেন অতিথি-নারায়ণ। কথাটা শুনে বুকের মাঝখানে মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে মনে খিঁচিয়ে উঠে বলে বসলাম, কই আমরা তো মাধুকরীর সময় তোমাদের সঙ্গে এই মানবিক ব্যবহার করি না!
বারান্দায় খাটিয়াতে বসে পড়লাম। ঘরের ভেতর থেকে পিতলের রেকাবিতে গুড়ের লাড্ডু, বাতাসা আর একটু চিঁড়ে মুড়কি দিয়ে গেলেন আনন্দ দাসী। জানতে পারলাম এটি শ্রীশ্রী রঘুনাথ জীউয়ের বাল্যভোগ। তারও কিছুক্ষণ পর এলো চা বিস্কুট। কথা শুরু করলো গোউর। আমি শুধু যোগ করলাম, কন্ঠিবদল কি এখানেই হবে? না না! আমার ও বোষ্টমীর স্বপ্ন ছিল শ্রীশ্রী রঘুনাথ জীউয়ের পাদপদ্মে অর্পণ করে গোপাল দাস বাবাজীকে সাক্ষী রেখে কন্ঠিবদল হবে দধিয়া বৈরাগ্য তলার মোচ্ছবে। তার জন্যও চাই প্রস্তুতি। প্রতিবছর মাঘ মাসের সপ্তমী তিথিতে মনের মানুষদের নিয়ে কন্ঠি বদল অনুষ্ঠান হয়ে আসছে কেতু গ্ৰামের দধিয়া বৈরাগ্য তলার মাঠে। এই উপলক্ষে গোউর আন্তরিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার মেয়ে ময়না দাসী’র সঙ্গে নহবত গাঁয়ের নাম করা কীর্তনীয়া বসন্ত দাস বৈরাগীর বড় ছেলে কৃষ্ণ দাসের কন্ঠিবদল হবে। বাবার মতোই কৃষ্ণদাসের নাম ডাক হয়েছে শ্রীখোল বাদক হিসেবে। কখনও দলে, কখনও বাবার সঙ্গে যায় শ্রীখোল বাজাতে। ছোট্ট বেলায় নিজের মা’কে হারিয়েছে কৃষ্ণ।
শ্রীশ্রী মহাপ্রভুর রাতুল চরণে ঠাঁই নেওয়ার কালে কৃষ্ণের খুড়ি যমুনা দাসীর কোলে সঁপে দিয়ে যায় কাজল দাসী। নিজের মা কাজলকে মনে পড়ে না কৃষ্ণের। তার কাছে খুড়িই- মা। এবার বাড়ির সবারই মত, কৃষ্ণের জন্য দাসী খুঁজে কন্ঠিবদল করাতেই হবে। তার জন্য বেশি খোঁজখবর বা তল্লাশি করতেও হয়নি তাদের। পাশাপাশি গ্ৰামগুলোতেই রয়েছে বৈষ্ণবদের বসতি। হাতের কাছেই মিলে গেল পাত্রী। অতএব ‘শুভস্য শীঘ্রম্’ ভেবে সামনের মাঘের পবিত্র দিনে শ্রীশ্রী রঘুনাথ জীউকে সাক্ষী রেখে হবে কন্ঠিবদল পর্ব। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল আমাদের। গোউর আরও একবার তিনজনকেই জোড় হাত করে বিনীত ভাবে গরীব বৈষ্ণবের বাড়িতে অন্ন গ্ৰহনের অনুরোধ জানালো। আমরা না করতে পারলাম না। কতবার এসেছি এই অঞ্চলের আখড়ায়, আশ্রমে, কিম্বা মোচ্ছবে। নানা সময়ে এলেও কারও বাড়িতে ওঠা হয়নি একবারের জন্য। আমরা সেই পুরোনো কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করছি তিনজনই। গোউরের কথার খেই ধরে মনে পড়ে গেল পাহাড়তলির গ্ৰামগুলোর অমলিন ছবি । গোউর তার জামাইকে যৌতুক বা উপহার হিসেবে শুশুনিয়ার কোলে থাকা তিনটি গ্ৰাম দান করবে কন্ঠিবদলের দিন। তার দান করা ওই তিনটি গ্ৰামে মাধুকরীর অধিকার থাকবে জামাই ও তার পরিবারের। নিত্যদিন মাধুকরী ছাড়াও হরিবাসর, প্রভাতী দেওয়া সহ সমস্ত বৈষ্ণবীয় ক্রিয়াকর্মও করবে জামাইয়ের পরিবার। বারোমাস্যা, হেঁসলা ও ধ্বতলা গ্ৰামে আর যাবে না গোউর কিম্বা তার পরিবারের কেউই। গৌরহরি দাসের এই নেমন্তন্ন ও গ্ৰামদান বলে দেয় সাম্যবাদের কৌলিন্য ধারার কথা। সারাটা দুপুর জুড়ে আমাদের গ্ৰাম অভিযান শেষ হল শুশুনিয়ার ঝর্নাতলায়।
(পরবর্তী অধয়্যায় আাগামী রবিবার)