লাগাতার আন্দোলনের চাপ আর সহ্য করতে না পেরেই তিনি সকাল সকালই স্বাস্থ্য ভবনে গিয়ে পদত্যাগপত্র দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সকাল থেকে বিকেল হতে না হতেই তিনিই ফের প্রিন্সিপালের দায়িত্বে বহাল হলেন অন্যত্র। কেবল জুনিয়র চিকিৎসকদের লাগাতার আন্দোলনের চাপে নয়, রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সেই আন্দোলনের ঢেউ। তারই মধ্যে সোমবার সকালে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করে যিনি জানান, কারও চাপে নয়, স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিকেল গড়াতে না গড়াতেই শহরের অন্য একটি মেডিক্যাল কলেজ, ন্যাশনালের অধ্যক্ষের পদে তাঁকে বহাল করে স্বাস্থ্যভবন। তবে হাই কোর্ট তাঁকে লম্বা ছুটিতে যেতে বলেছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিকেল ৩টে পর্যন্ত সময় দিলাম। এর মধ্যে অধ্যক্ষকে স্বেচ্ছায় ছুটিতে চলে যেতে বলুন। না হলে আমরা নির্দেশ দিতে বাধ্য হব। কীভাবে একজন ইস্তফা দেওয়ার পর, ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে ফেরত আনা হল? আপনি কি এত পাওয়ারফুল লোক? আপনি হাসপাতালের অভিভাবক। আপনার যদি নির্যাতিতার প্রতি সহানুভূতি না থাকে, তাহলে আর কার থাকবে?
গত শুক্রবার থেকে সারা রাজ্যেই খুব পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি। সমাজমাধ্যমে তাঁর একটি ছবিও ঘুরছে।রাজ্যবাসীর মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে তাঁর নাম, তাঁর ‘প্রভা’ এবং ‘প্রতাপ’-এর কথাও বলছেন অনেকে। জানা গিয়েছে, তাঁর ঘরে ঢুকতে গেলে চার চারটি স্তরের নিরাপত্তা পেরতে হত। তাছাড়া তিনি পেতেন সরকারি নিরাপত্তাও। গত শনিবার থেকে তাঁর আরেকটি ছবি দেখা যায়- গাঢ় নীল ট্রাউজ়ার্সে গোঁজা সাদা ফুলহাতা শার্ট। সবুজ আবিরে মাখা মুখ, মাথা, জামার সামনের অংশ। আঙুলে ‘ভি’ অর্থাৎ ‘ভিকট্রি’। তিনি যে বিজয়ী সেকথা জানাতেই ওই চিহ্ণ। ওই আবির আর ভিকট্রি চিহ্ণ দিয়ে তিনি লোকসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের বার্তা দিয়েছিলেন। শুধু কি তা? আসলে তিনি নিজেকে ‘তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ’বলেই জাহির করতে চেয়েছেন, তিনি শাসকদলের ‘আস্থাভাজন’ একথাও বোঝাতে জানাতে চেয়েছেন। তাঁর তরফে জাহির করা বা জানাতে বোঝাতে না চাওয়ার তো কিছু নেই। কার্যত স্বাস্থ্যভবনে তাঁর ‘প্রভাব’ বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তা না হলে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা একাধিক অভিযোগে তাঁকে একাধিক বার বদলি করা হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ফিরে এসেছিলেন আরজি করের অধ্যক্ষের পদে। এক বার তাঁর পরিবর্তে উলুবেড়িয়ার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সনৎ ঘোষকে আরজি করে আনা হয়েছিল। কিন্তু কোনও এক ‘অজ্ঞাত’ কারণে অল্প সময়ের মধ্যে ফের তিনি ফিরে আসেন। দ্বিতীয়, গত সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রীর স্পেন-দুবাই সফরের আগেই তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের অস্থি বিভাগে বদলি করা হয়েছিল। ২১ দিনের মাথায় আবার তিনি আরজি করে ফেরেন। এমন অভিনব বদলির কথা কেউ কি কখনো শুনেছেন? মনে হয় না।
বেলেঘাটাবাসী এই সন্দীপ ঘোষ আরজি কর মেডিকেল কলেজেরই প্রাক্তনী। সোমবার চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর তিনি বলেন, তিনি যখন আরজি কর মেডিক্যালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন সেখানে ঘুঘুর বাসা ছিল। বার্থ সাটিফিকেট নিতেও ঘুষ দিতে হত। কোনও কোনও নেতার মদতও ছিল। তিনি সেগুলি বন্ধ করেছেন বলেই নাকি এত বিরোধিতা। আসলে আরজি কর হাসপাতেলের অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলানো সন্দীপের বিরুদ্ধে দফায় দফায় একাধিক অভিযোগ উঠেছে। যার মধ্যে হাসপাতালের সরঞ্জাম পাচার, তহবিল তছরুপ, স্টাফ কোয়ার্টারে বেআইনি ভাড়াটে বসানো, ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে ডাক্তারি পড়ুয়াদের নিজের দিকে রাখা, বেআইনি পার্কিং থেকে টাকা তোলা ইত্যাদি। এসব কি প্রশাসন জানে না? তা কি করে হয় আসলে প্রশাসন জেনেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পদক্ষেপ করেনি।
যদিও হাসপাতালের মধ্যে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার গোড়া থেকে সন্দীপ ঘোষের ভূমিকায় তৃণমূলের একাংশ ক্ষুব্ধ। এর আগে অভিযোগ উঠেছিল, ‘রাতে একা একা সেমিনার হলে থাকা উচিত হয়নি’ নির্যাতিতা ট্রেনি চিকিৎসককে নিয়ে নাকি এমনই মন্তব্য করেছিলেন আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। বহু পড়ুয়া এবং চিকিৎসক তাই সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। আদালতের তরফে সাফ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপাতত কোনও মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা যাবে না সন্দীপ ঘোষকে। এদিকে এই ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয় সিবিআইয়ের হাতে। উল্লেখ্য, সোমবার আর জি করের নির্যাতিতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা পুলিশকে কার্যত ‘আলটিমেটাম’ দিয়ে দেন। তিনি জানিয়ে দেন, রবিবার পর্যন্ত পুলিশ যদি তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না করতে পারে, তাহলে তিনি এই মামলা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু হাই কোর্ট রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নয়। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, পাঁচ দিন কেটে গেলেও এই ঘটনার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।প্রসঙ্ত, মুখ্য়মন্ত্রী ৬ দিনের ডেডলাইন দিয়েছিলেন। কলকাতা হাইকোর্ট একদিন সময় নিল। মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের ডেডলাইনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্য়ে, প্রথম শুনানিতেই পুলিশ-হাসপাতালের ভূমিকায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে আর জি কর-কাণ্ডে আদালতের নজরদারিতে CBI তদন্তের নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট।