চতুর্থ পর্ব
কোনরকমে জায়গা করে দেওয়া প্রবীণা জানালেন তিনিও কয়েকবার ভারতে অর্থাৎ কলকাতায় এসেছেন। মূলত চিকিৎসার জন্য হলেও নিউ মার্কেট থেকে অনেক সাজসজ্জার জিনিস কিনে নিয়ে গিয়েছেন। খুব শীঘ্রই আবার আসবেন কলকাতা, উদ্দেশ্য দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত চিকিৎসা ক্ষেত্র ভেলোর’ যাওয়া। তবে ইতিমধ্যেই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে অনেক লিষ্ট এসে গেছে কেনাকাটার। একটা দিন নাকি ধার্য্য করে রেখেছেন শুধু কেনাকাটার জন্য। বুঝলাম আমাদের দিদি, বৌদির মতোই ভদ্রমহিলা কেনাকাটা করতে ভালোবাসেন। গিন্নী গিন্নী চেহারার স্নেহ মাখা এই প্রবীণাকে দেখেই খুব আপন মনে হয়। এন্তার হাসতে পারেন। ভেলোর এর আগে যাননি শুনে, কয়েকটি পরামর্শ দিয়ে রাখলাম। কারণ আমার কর্ম সুত্রে ভেলোর বাসের কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে সময় বহু বাংলাদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এবং তাদের অনেকেই প্রতারিত হয়েছিলেন বাংলাভাষী এ বাংলার দালালদের কাছে। আমার কাছে ভদ্রমহিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক খোঁজে খবর নিলেন এবং অবধারিত ভাবে আমন্ত্রণ জানালেন নিজের বাড়িতে। সেটা এ যাত্রায় সম্ভব নয় জেনে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন কি করে যেতে হবে। আমার আপাত গন্তব্য ফকিরহাট।
ভদ্রমহিলা বেশ আড্ডাবাজ, গল্পে গল্পে জানলাম বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের সময় তিনি কিশোরী হলেও অনেক কিছুই তাঁর মনে রয়েছে। অনেকের মতো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়নি তাঁর পরিবারকে কারণ তাঁর বাবা ছিলেন সে সময়ের এক দারগা আর এক তরুণ দারগার সঙ্গে তাঁর তখন বিয়েরও ঠিক হয়ে আছে। বলা যায় তিনি সেই কিশোরীবেলা থেকেই পুলিশ বেষ্টিত এবং পুলিশ পরিবারের মেয়ে। দারোগা স্বামী এখন অবসর নিয়েছেন, দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরছেন খুলনায়। তাঁর স্মৃতিতে দগদগে হয়ে গেঁথে রয়েছে সেই কিশোরী বেলার ভয়ংকর সব ছবি।
রাত প্রায় ৮টার কাছাকাছি আমরা পোঁছে গেলাম খুলনা। বেশ ঝকঝকে গোছানো স্টেশন। স্টেশনের মূল চত্বরে এসে চমকে গেলাম। আমাদের এখানকার মতো শুধুমাত্র কোনো বইয়ের দোকান নয়, আস্ত একটা লাইব্রেরি রয়েছে। নামটাও কি সুন্দর কাব্যিক, “ভালোবাসার পাঠশালা”। খুলনা পাবলিক কলেজের ছাত্র, শিক্ষক ও শুভানুধ্যায়ীদের উদ্যোগে এই অসাধারণ কর্মকাণ্ডটি ঘটে চলছে। ট্রেনের প্রতিক্ষায় থাকা যাত্রী এখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারেন। বইয়ের র্যাকের গায়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘এখানে বসে পড়ুন’। ‘পড়া শেষ না হলে নিজ দায়িত্বে বইটি নিয়ে যান, এবং প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ১ মাস রাখুন’। ‘পড়া শেষ হলে নিজ দায়িত্বে বইটি ভালোবাসার পাঠশালাতে পাঠিয়ে দিন’। ‘সম্ভব হলে এক বা একাধিক বই আপনার নামে এই পাঠশালায় উপহার দিন’।
‘মনে রাখবেন, যিনি পাঠসূচীর বাইরে বই পড়েন তিনি সমাজের ক্ষতি অথবা কর্মক্ষেত্রে কোন অনৈতিক কাজ করতে পারেন না। পড়ার জন্য রয়েছে সুন্দর ব্যাবস্থা, নেই শুধু আপনাকে বই দেওয়ার কিংবা আপনার ফেরত দেওয়া বই নিয়ে আলমারিতে সাজিয়ে রাখার কেউ। সবই নিজ দায়িত্বে, নিজের দায়িত্বে বই নিন নিজের দায়িত্বে ফেরত দিয়ে সাজিয়ে রাখুন। ভাবা যায় একটা ছোট্ট নবীন দেশ তার নাগরিকদের জন্য এমন অভিনব এমন আধুনিক ভাবনা ভাবতে পারে। আর আমরা শুধু বাতেলা ছাড়া আর কি পারি। খুব ইচ্ছে ছিল বেশ কিছুটা সময় কাটাই, আরও কিছু বই উল্টেপাল্টে দেখি। কিন্তু আমাকে যেতে হবে আরও বেশ খানিকটা দূরে তাই ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হল না।
খুলনা রেল স্টেশন তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতে। তখন এখান থেকে ছিল শেয়ালদার নিয়মিত যোগাযোগ। শেয়ালদা থেকে যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত রেল পথের এটাই ছিল প্রান্তীক স্টেশন। এই রেল পথেই ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’ শেয়ালদা থেকে খুলনা পর্যন্ত, ভায়া পেট্রাপোল-বেনাপোল হয়ে চলাচল করতো। ১৯৫৬ সালে ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধের সময় এই রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের পরে খুলনা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর যা খুলনার রেল স্টেশন ও রূপসা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। রূপসা ও ভৈরব নদীর তীরে গড়ে ওঠা খুলনা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম এক শিল্প ক্ষেত্র। খুলনা নদী বন্দর এদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ব্যস্ততম বন্দর। খুলনাকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বারও বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের এই সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ জঙ্গল এবং বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে খুলনা ছিল নাকি প্রাচীন বঙ্গ ও সমতট রাজ্যের অংশ। এটি ১২শ শতকে বল্লাল সেনের রাজত্বকালে সেন রাজবংশের একটি অংশ হয়ে ওঠে। ১৪শ শতকে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ প্রথম মুসলিম শাসক যিনি এ শহরে আসেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময়ে এখানে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং অনেক মসজিদ ও মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন মুসলিম সাধক, খান জাহান আলী, ১৫শ শতকে গৌড়ের রাজার কাছ থেকে বর্তমান খুলনা বিভাগের একটি বড় অংশের জায়গির পেয়ে এই অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করে জাহানাবাদ রাখেন। আলীর মৃত্যুর পর শহরটি আবার বাংলার সুলতানদের শাসনাধীন হয়ে যায়। ১৬শ শতকে দাউদ খান কররানির শাসনকালে দক্ষিণ বাংলায় খুলনা-সহ ঈশ্বরীপুরে (বর্তমান সাতক্ষীরা জেলায়) একটি সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। এই রাজ্যের অন্যতম শাসক ছিলেন প্রতাপাদিত্য, যিনি বারো ভূঁইয়াদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেন এবং দক্ষিণ বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। ১৬১১ সালে প্রতাপাদিত্য মুঘল সম্রাট আকবরের হিন্দু রাজপুত সেনাপতি রাজা মান সিং প্রথমের কাছে পরাজিত হন। এরপর ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজামত (স্থানীয় শাসন) বাতিল করে এবং শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৪৭ সালের ১৯ আগস্টের আগে পর্যন্ত খুলনা ছিল অবিভক্ত বাংলার অংশ।পরে সৈয়দ মোহাম্মদ আবদুল হালিম, বাঙালি সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা খুলনাকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান এবং সীমানা কমিশন ঘোষণা করে যে শহরটি পূর্ব বাংলার অংশ।
স্টেশনের বাইরের চত্বর আমাদের মতো হকার দখল করে রাখেনি, বেশ প্রসস্থ এবং পরিষ্কার। বাঁ পাশে এক খোলা সবুজ মাঠ তারপর শুরু হয়েছে দোকান দানি। তবে অটো আর রিকশার টানাটানি প্রায় আমাদের ওখানকার মতোই। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার ভিড়ও কম নয়। রাস্তার পাশে একই চরিত্রের সারি সারি চা দোকান। তবে প্লাস্টিকের গ্লাস চোখে পড়লো না, দেখলাম এরা এখনও সেই সাবেকি কাঁচের ছোট গ্লাসেই চা দেয়। খুলনা স্টেশনের বাইরে দেখা হল আমাদের প্রথম বাংলাদেশি বন্ধু রনি’র (রনি সেন) সঙ্গে। রনি তার বাইক নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। একেবারে ঝকঝকে তরুণ রনির সঙ্গে অবশ্য আমার প্রথম পরিচয়, বয়সের ব্যাবধানও বেশ খানিকটা। চা সিগারেট খেয়ে সে ব্যাবধানটা আমিই ঘুচিয়ে দিলাম। রনির পরামর্শে আমরা বাসস্ট্যান্ডে না গিয়ে ওর বাইকে চেপে চলে এলাম রূপসার ফেরি ঘাটে।
তথ্য সুত্র:-
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্বকোষ
চলবে…