(গত সপ্তাহের পর)
শুশুনিয়ার অবিরাম বয়ে চলা ঝর্নার জলে স্নান সেরে নিচ্ছে সবাই। আমরাও তিনজন স্নানের প্রস্তুতি নিলাম। এই ভরদুপুরে পাহাড়তলীর কোনও মা, বোন কিম্বা গ্ৰাম্য বধূর দল আসে না জল নিতে। শুধু ভক্ত পুণ্যার্থী, ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় থাকে ঝর্নাতলায়। স্থানীয় দোকানদার আর গ্ৰামীন মানুষও সামিল হয় ধারা স্নানে। তাদের কাছে এটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমরা এই প্রথম উন্মুক্ত পরিবেশে ঝর্নার জলে স্নান সারবো বলে আলাদা অনুভুতি হচ্ছে মনে। বাঁধানো চাতাল, ঠিক মাঝখান বরাবর মাথার উপরে সিংহের মুখ থেকে জল ঝরে পড়ছে প্রপাতের মতো। স্নান সেরে বাড়ির জন্য অনেকেই পবিত্র বারিধারা ভরে নিচ্ছে ক্যানে, বোতলে। ঝর্নার ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে শ্রীশ্রী ভগবান বিষ্ণুর অবতার নৃসিংহদেবের শিলা স্তম্ভ। রক্তবস্ত্রে আবৃত ও চন্দন, হলুদ ও সিন্দুরে চর্চিত তিনি। গলায় ঝুলছে পৈতে, মালা। পুরোহিতের নিত্য পূজা কর্ম শেষ হয়ে গেছে। তবুও ভক্ত,পুণ্যার্থীদের জন্য বসে আছেন। অনেকেই স্নান সেরে পুজো দেন। আবার অনেকের মানত থাকে। তারাও পুজো ও মানতের উপচার সামগ্রী নিয়ে অপেক্ষা করেন। আজ তুলনামূলকভাবে ভিড় অনেকটাই কম। বছরে সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় শ্রাবনী তিথির ধারার মেলায়। লোকে শুশুনিয়ার বারুনী মেলা বলেই চেনে। অগণিত বাবা ভোলানাথ-এর ভক্ত এখানে বাঁক কাঁধে জল নিয়ে যায় বিভিন্ন শৈব তীর্থে। সে কি ধূম! তখন এই শান্ত নিরিবিলি নির্জন বন পাহাড় উত্তাল হয়ে ওঠে মাইক,সাউন্ড বক্স আর ডিজের দৌলতে। প্রশাসন হিমসিম খেয়ে যায় সামাল দিতে। আবার চৈত্র, বৈশাখেও উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। কবে থেকে এই মেলা বা তীর্থস্থানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত তা কেউই স্পষ্ট ও সঠিকভাবে বলতে পারেন না। তবে এর একটি ঐতিহাসিক ব্যাকগ্ৰাউন্ড ও ভূ-জৈব পরিবর্তনের মহামূল্যবান ইতিহাস আছে। বিশ্বের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বুকে ধারন করে রেখেছে শুশুনিয়া।
ঝর্নাতলার ঠিক পিছনে দক্ষিণমুখে রয়েছে আশ্রম আর মায়ের মন্দির। সমতল থেকে অনেকটাই উঁচুতে পাহাড়ের ঢালে মন্দির আর আশ্রমের অবস্থান। মহা ধূমধামের সঙ্গে দুর্গোৎসব আর মা কালীর পূজা আরাধনা হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। আশ্রমের এই উৎসবকে সার্থক করে তোলে স্থানীয় গ্ৰাম গ্ৰামান্তরের মানুষ। দূর দূর জায়গা থেকেও আসে বহু মানুষ। মনোরম পবিত্র পরিবেশ এই আশ্রমের। দু’দন্ড বসে কাটানো যায় শান্তি মনে। প্রকৃতি পরিবেশ কত উদার! কত ঘনিষ্ঠ!
আমরা ঝর্নাতলা ছেড়ে চললাম গোউর দাসের বাড়ির পথে। আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে সবাই। অতিথি বৎসল নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবার। তাঁদের আরাধ্য কুলদেবতার অন্নভোগ প্রসাদ সেবা করার জন্য কত অনুরোধ উপরোধ করলেন বাড়ির প্রবীন মানুষজন। ভাবতে ভাবতে পৌঁছেও গেলাম গোউরের বাড়ির সদর দরজায়।
(পরবর্তী অধ্যায় আগামী রবিবার)