গেল শতাব্দীর সাতের দশকে এ দেশের সমান্তরাল সিনেমার জন্মলগ্ন থেকে তিনি ছিলেন পোস্টার বয়। পরবর্তীতে বাণিজ্যিক বা মশলা সিনেমার ক্ষেত্রেও তাঁর অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর প্রমাণিত হয়েছে। আজ নাসিরুদ্দিন শাহের জন্মদিন।
আমাদের দেশের অধিকাংশ অভিনেতারাই সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পান। বস্তুতপক্ষে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যায় যে বিষয়ে তাঁদের কথা বলাটা খুব জরুরী বলেই মনে হয়। কিন্তু তাঁরা এড়িয়ে যান। ভয়েই হোক বা অন্য যে কোনো কারণে তাদের কথা না বলা নিয়ে অভিনেতা নাসিরুদ্দিন বলেন, এই নীরবতাই একদিন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয় উঠবে।নাসির মনে করেন, একজন অভিনেতার অবশ্যই রাজনৈতিক দর্শন থাকতে হবে। সেই দর্শনের মধ্যে দিয়েই তার সিনেমার ধরণটা সামনে আসে।

বরাবরই নিজের মতামত জোরের সঙ্গে বলার জন্য পরিচিত নাসিরুদ্দিন শাহ। চুপ থাকাটা ওঁর ধাতে সয় না। সমাজ ও রাজনীতির ব্যাপারে তিনি যে স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্পষ্টবাদী তা আমরা বারবার দেখেছি।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় সিনেমা সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাস ও ভাবনার কথা বলতেও তিনি কখনও দ্বিধা বোধ করেন না। বলিউড সম্পর্কে তাঁর ধারনা, keep the audience dumb। দর্শকদের আবর্জনা গেলাও, যাতে তারা ভাল ছবির দাবি না তোলে। হিন্দি ছবির ১০০% প্রডিউসার এই লক্ষ্য নিয়েই ছবি বানান। সাতের দশক থেকে এই পচনের শুরু। গল্প চুরি থেকে বাকি সব কিছু।

রাজ কাপুরের কিছু ছবি সম্পর্কে তাঁর অভিমত, কিছু আইডিয়া চার্লি চ্যাপলিনের থেকে নেওয়া আর বাকি সব অন্য ছবি থেকে তোলা। এমনকি বিমল রায়ের কিছু ছবি নিয়ে তিনি বলেন, ভিত্তরিয় ডি সিকা-র ফিল্মগুলি থেকে কপি করা হয়েছে।
তবে তাঁর মতে, ভি শান্তারাম ওরিজিনাল ফিল্ম বানাতেন। কে. এ. আব্বাসও বানাতেন। মৌলিক সিনেমা করেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত কম। অধিকাংশই চুরি করতেন। আর তারাই অডিয়েন্সের রুচিকে বিষাক্ত করে দিয়েছেন বলে নাসিরুদ্দিনের বিশ্বাস।

সত্তর দশকের ছবিগুলি ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল। অনেকদিন ধরেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছিলেন জিতেন্দ্র, দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার সহ আরও অনেকে। সেই সময় ওই একঘেয়েমিটা কাটানোর জন্যই প্রয়োজন হয়েছিল রাজেশ খন্নার। ইন্ডাস্ট্রি নিজের প্রয়োজনেই ওকে তৈরি করে নিয়েছিল। নাসিরুদ্দিনের এ ধরণের মন্তব্যকে বলিউড ভালভাবে যে নেয় নি তার প্রমান বারেবারেই তাঁর মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক। কিন্তু তিনি চুপ থাকতে পারেন না।
সিনেমার দুনিয়া ছাড়াও অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ’র মন্তব্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ময়দানও উত্তপ্ত হয়েছে বারবার। নাসিরুদ্দিন শাহ’র মন্তব্য প্রকাশ্যে আসার পরেই বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’, ‘দেশবিরোধী’ বলে আক্রমণ করেছে।

কিন্তু তাতে তাঁর কিছছু যায় আসে নি। তারপরও তিনি মুখ খুলেছেন দেশের শাসক ও দলের বিরুদ্ধে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সিএএ থেকে শুরু করে জেএনইউ, আলিগড় বিশব্বিদ্যালয়, বুলন্দশহরে গোহত্যার গুজবকে কেন্দ্র করে পুলিশ কর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা- নাসিরুদ্দিন সুর চড়িয়েছেন।
অভিনয় জীবনে প্রচুর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন নাসিরুদ্দিন শাহ। ‘পার’, ‘স্পর্শ’, ‘ইকবাল’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। আবার ‘আক্রোশ’, ‘চক্র’, ‘মাসুম’-এর মতো সিনেমার জন্যও তিনি পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। তবে নাসিরুদ্দিনের কাছে এই অ্যাওয়ার্ডগুলোর বিশেষ কোনো মূল্য নেই।

সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে নাসিরুদ্দিন শাহ বলেন, ‘কোনো অভিনেতা যখন কোনো চরিত্রে নিজেকে সঁপে দেয় সে আমার মতে ভালো অভিনেতা। এবার আপনি যদি অনেক অভিনেতার মধ্যে থেকে একজনকে সেরা হিসেবে বেছে নেন, তাহলে তা কেমন করে ন্যায়সংগত হয়? আমি এই সমস্ত অ্যাওয়ার্ডে মোটেও গর্বিত নই।’
অভিনেতা আরও বলেন, ‘আমি শেষ দু-দুটি অ্যাওয়ার্ড নিতেও যাইনি। তাই যখন ফার্ম হাউস তৈরি করলাম, এগুলোকে সেখানে এভাবে রাখব বলে ঠিক করলাম। কাউকে যদি বাথরুমে যেতে হয়, তাহলে তারা ফিল্মফেয়ার দিয়ে তৈরি দু-দুটি হ্যান্ডেল সেখানে পাবে।’
ব্যক্তিজীবনে স্পষ্টভাষী অভিনেতা নিজেই তাঁর মারিজুয়ানা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন এবং বলেন, “আমি এটাতে অন্যদের উৎসাহ দেব না, কিন্তু এটা গ্রহণ আমাকে নিজের ভাবনা আর লক্ষ্য আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করে।” নিজের অভিনয় প্রসঙ্গে তিনি যাই বলুন না কেন, তাঁকেও সিনেমার নায়কদের মতো পর্দায় নাচতে, গাইতে এবং খারাপ লোকদের সাথে মারামারি করতে দেখা গিয়েছে, কিন্তু তিনি কি বোঝেন যে সেসব তাঁকে কতটা মানিয়েছে!